জয় হলো হাথুরুসিংহেরই

ম্যাচ শেষে চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে কিছু একটা বলতে গেলেন তামিম ইকবাল। হাথুরুসিংহে অবশ্য চুপই থাকলেন। যা করার সেটি তো মাঠেই করে দেখিয়েছেন। কাল সিলেটে।  ছবি: শামসুল হক
ম্যাচ শেষে চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে কিছু একটা বলতে গেলেন তামিম ইকবাল। হাথুরুসিংহে অবশ্য চুপই থাকলেন। যা করার সেটি তো মাঠেই করে দেখিয়েছেন। কাল সিলেটে। ছবি: শামসুল হক

গত এক মাসে সবই হলো। শুরুটা জয় দিয়ে। কিন্তু এরপর টানা ব্যর্থতার গ্লানিতে বাংলাদেশ দল এতটাই নিমজ্জিত যে, সেই জয়ের কথা এখন আর কেউ মনে করছে না। ত্রিদেশীয় সিরিজে জিম্বাবুয়েকে দুবার হারানো, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচের জয়-সবই দূর অতীত। বর্তমানের খাতায় শুধুই হতাশা। সিলেটে কাল শেষ টি-টোয়েন্টিতেও ৭৫ রানে হারার পর এই এক মাসে বাংলাদেশ দলের অর্জন আসলে শূন্য।

ত্রিদেশীয় সিরিজে জিম্বাবুয়ে তৃতীয় দল হিসেবে থাকলেও লড়াইটা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার মধ্যে। বাংলাদেশ থেকে বিতর্কিতভাবে চলে যাওয়া চন্ডিকা হাথুরুসিংহে শ্রীলঙ্কা দলের কোচ। নিয়তির কী খেলা, শ্রীলঙ্কার দায়িত্ব নিয়ে প্রথম লড়াইটাই কিনা লড়তে এলেন বাংলাদেশের সঙ্গে! শ্রীলঙ্কার চেয়েও বাংলাদেশের বড় প্রতিপক্ষ হয়ে উঠলেন হাথুরুসিংহে। শ্রীলঙ্কাকে হারাতে পারলে হারানো হবে হাথুরুসিংহেকে। শ্রীলঙ্কার কাছে হারলে হারতে হবে আসলে হাথুরুসিংহের কাছেই। ত্রিদেশীয় সিরিজের পর দুই টেস্টের সিরিজ এবং টি-টোয়েন্টিতেও বজায় থাকল ‘মর্যাদার লড়াই’-এর এই সমীকরণ। কিন্তু বাংলাদেশ কোথাও হারাতে পারল না সাবেক কোচকে। শেষ পর্যন্ত জয় হাথুরুসিংহের। হাসি তাঁর মুখেই।
কিন্তু বাংলাদেশ কি আসলেই হাথুরুসিংহের কাছে হারল, নাকি হারল নিজেদের কাছে? হাথুরুসিংহে দায়িত্ব নেওয়ার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে আসে শ্রীলঙ্কা। এত অল্প সময়ের মধ্যে একটা দলকে আর কতটুকুই বদলাতে পারেন কোচ! হতে পারে বাংলাদেশ দলের নাড়ি-নক্ষত্র তাঁর জানা ছিল। নতুন দায়িত্ব নিয়ে সে অস্ত্রটাই তিনি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু উল্টোভাবে ভাবলে বাংলাদেশও তো হাথুরুসিংহের চিন্তাকে ফাঁকি দিতে পারল না!

ত্রিদেশীয় সিরিজে আশা-জাগানিয়া শুরু করেও ক্রমেই পিছিয়ে যায় বাংলাদেশ দল। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও বিসিবির সাবেক পরিচালক গাজী আশরাফ হোসেন মনে করছেন, শ্রীলঙ্কার কাছে ফিরতি ম্যাচে হারাটাই বাংলাদেশ দলের গতিপথ ঘুরিয়ে দেয়, ‘শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ফিরতি ম্যাচটাতে আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। শ্রীলঙ্কা নিজেদের ফিরে পাওয়াতেই পরিস্থিতি ঘুরে যায়। আমার মনে হয়, ওই ম্যাচটাকে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে নিইনি।’

২০১৪-এর জুনের পর বাংলাদেশ দলকে সবচেয়ে এলোমেলো লেগেছে এই সিরিজেই। গত কয়েক বছরে যে দলটা ঘরের মাঠে বড় বড় দলকে কাঁপিয়ে দিয়েছে, সেই দলটাই এই সিরিজে নিজেদের মাটিতে একের পর এক অসহায় আত্মসমর্পণ করে গেছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল পরিকল্পনায়। নিজেদের মাঠ-উইকেটের সুবিধা নিতে পুরোপুরি ব্যর্থ দল। স্পিন বোলিংয়ের বিপক্ষে শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানদের দক্ষতা নতুন কিছু নয়। স্পিন বোলিংয়েও দলটা দুর্দান্ত। অথচ তাদের বিপক্ষেই কিনা স্পিন উইকেট বিছিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ! সেই উইকেটও আবার সব সময় নিজেরা ঠিকভাবে পড়তে পারেনি। নইলে চট্টগ্রামের ব্যাটিং উইকেটেও বাংলাদেশ কেন তিন স্পিনার খেলাবে? কেমন উইকেটে খেলা হবে, তা নিয়েও দ্বিধা কাজ করেছে টিম ম্যানেজমেন্টের মধ্যে। অধিনায়ক-কোচ এক রকম উইকেট চেয়েছেন, টেকনিক্যাল ডিরেক্টর চেয়েছেন আরেক রকম। সব মিলিয়ে ঘরের মাঠের সুবিধা কাজে লাগাতে গিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থার মধ্যে পড়েছে দল।

গাজী আশরাফ হোসেন উইকেটের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘এই সিরিজে আমরা ভালো উইকেটে বলতে গেলে খেলিইনি। অসম বাউন্স, বল ব্যাটে আসে না-এমন উইকেট কখনোই আদর্শ উইকেট নয়। এই জিনিসগুলো আমাদের বোর্ড কর্মকর্তাদের বোঝা উচিত। তা ছাড়া একটি ত্রিদেশীয় সিরিজের সাতটি ম্যাচ কখনো একই ভেন্যুতে হওয়া উচিত নয়। এতে করে কিউরেটর উইকেট বানানোরও সময় পান না।’

নির্বাচকদের ঘোষিত দল থেকে শুরু করে একাদশ নির্বাচনেও প্রকটভাবে ধরা পড়েছে সিদ্ধান্তহীনতা। আঙুলের চোটে সাকিব আল হাসান টেস্ট সিরিজ থেকে ছিটকে যাওয়ার পর প্রথম টেস্টের স্কোয়াডে দুই দফায় ডাকা হয় আবদুর রাজ্জাকসহ তিন স্পিনারকে। কিন্তু নির্বাচকদের চিন্তার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি টিম ম্যানেজমেন্টের চিন্তার। চার বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ডাক পাওয়া রাজ্জাককে ছাড়াই করা হলো একাদশ। প্রথম টেস্টে ৫৩ বলে ৮ রান করে ব্যাটিংয়ে টেস্টের মেজাজ দেখানো মোসাদ্দেক হোসেনকে দ্বিতীয় টেস্টের দল থেকে বাদ দেওয়া, টানা ব্যর্থ সাব্বিরকে বারবার সুযোগ দেওয়া, পেসার সাইফউদ্দিনের ওপর অতিরিক্ত আস্থা-এ রকম আরও অনেক উদাহরণই দেওয়া যায়। তবে খেলোয়াড় নির্বাচনে সিদ্ধান্তহীনতাটা বেশি প্রকাশ পাবে দুটি তথ্যেই। এই এক মাসে বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলেছেন মোট ২৮ জন খেলোয়াড়, টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে অভিষেক হয়েছে সাত ক্রিকেটারের। এর মধ্যে টি-টোয়েন্টিতেই ছয়জন! এর আগে এক বছরে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ৩১ জন খেলোয়াড় খেলার রেকর্ড আছে। এ বছর দুই মাসেই ২৮ জনের খেলে ফেলা যেন নতুন রেকর্ডের হাতছানি দিচ্ছে।

পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তহীনতার অন্যতম বড় কারণ দলের সঙ্গে অভিজ্ঞ কোচ না থাকা। বিদায়ী কোচ হাথুরুসিংহের সঙ্গে লড়াইটা বাংলাদেশ লড়তে গেছে বলতে গেলে কোচ ছাড়াই। হাথুরুসিংহে চলে যাওয়ার পর বিদেশি কোচ না পেয়ে বিসিবি টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পদ দিয়ে সিরিজের দায়িত্ব দেয় খালেদ মাহমুদকে। কিন্তু বাংলাদেশের অনেক ক্রিকেটারের মতো কোচ হিসেবে তিনিও প্রমাণ করে দিয়েছেন-ঘরোয়া ক্রিকেট আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এক নয়। হাথুরুসিংহের মস্তিষ্কের সঙ্গে পেরে ওঠেনি মাহমুদের মস্তিষ্ক।
ব্যর্থতার দায়ভার তাই শুধু ক্রিকেটারদের নয়। গলদ ছিল চিন্তা, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নেও। ফল-বাংলাদেশের খেলোয়াড়, টিম ম্যানেজমেন্ট মিলে হাথুরুসিংহেকে হারাতে না পারলেও হাথুরুসিংহে একাই হারিয়ে দিলেন সবাইকে।