১০ সেকেন্ডে গোল করা বিশ্বকাপ নায়কের প্রতি সেকেন্ডের ভয়

>
বিশ্বকাপে তাঁর সেই গোল এখনো মনে আছে অনেকের। ছবি: রয়টার্স
বিশ্বকাপে তাঁর সেই গোল এখনো মনে আছে অনেকের। ছবি: রয়টার্স

• ২০০২ বিশ্বকাপে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের মাত্র ১০.৮ সেকেন্ডে গোল করেছিলেন সুকুর
• বিশ্বকাপের দ্রুততম গোলের মালিক এখনো তিনি
• রাজনৈতিক কারণে তুরস্ক সরকারের রোষানলে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন

দুই পাশে ছড়ানো হাত দুটি যেন পাখির ডানা। হাকান সুকুর যেন উড়ছিলেন! উড়ে যেতে আর পারলেন কই? হারিয়ে গেলেন সতীর্থদের ভালোবাসার আলিঙ্গনে। ২০০২ বিশ্বকাপে সুকুরের সেই ডানা মেলা ছবিটির কথা মনে আছে? স্বাগতিক দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে তুরস্কের প্রথম গোলটি করে উড়ছিলেন সুকুর। দেগুর বিশ্বকাপ স্টেডিয়ামের ৬৩ হাজার দর্শক তখনো ঠিকঠাকভাবে নিজেদের আসনে বসতে পারেননি। ম্যাচের মাত্র ১০.৮ সেকেন্ড। এর মধ্যেই সুকুরের সেই গোল। বিশ্বকাপের দ্রুততম গোল করে হয়ে গেলেন ইতিহাস।
বলা হচ্ছিল সুকুরের ‘হারিয়ে যাওয়ার’ কথা। তুরস্কের ফুটবল ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় জীবনচলার পথে সত্যি ‘হারিয়ে’ গেছেন। কারও ভালোবাসার আলিঙ্গনে নয়, তুরস্ক সরকারের রোষানলে পড়ে! রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে নির্বাসিত। জীবন নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছেন। বসবাস করছেন দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে, মার্কিন মুলুকে।
এবার আরেকটি ছবি মনে করার চেষ্টা করুন, যেটি ১৯৯৫ সালের জুলাইয়ের কোনো এক সন্ধ্যার। নববিবাহিত সুকুর আর এসরা এলবিরলিকের দুই পাশে তুরস্কের সবচেয়ে নামী ব্যক্তিদের দুজন। এক পাশে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, আরেক পাশে লেখক ও রাজনীতিক ফেতুল্লা গুলেন। সুকুর-এলবিরলিকের বিয়ের অনুষ্ঠান তুরস্কের রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছিল। যেটি হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী তানসু সিলারের সৌজন্যে।
এলবিরলিকের সঙ্গে বিয়েটি সুখের হয়নি সুকুরের। দ্রুতই দুজনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। পরে ১৯৯৯ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পে এলবিরলিকসহ তাঁর পুরো পরিবারই প্রাণ হারিয়েছিল। তবে সুকুরের নির্বাসিত জীবন এ কারণে নয়। একসময় তুরস্কে বীরের মর্যাদা পেয়ে যাওয়া এই সাবেক তারকার জন্য কাল হয়েছিল রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া।
৩৬ বছর বয়সে ফুটবলকে বিদায় জানানোর পর প্রথমে খেলাটির সঙ্গেই ছিলেন। কাজ করতেন ধারাভাষ্যকার ও ফুটবল পণ্ডিত হিসেবে। এরপর এরদোয়ানের হাত ধরেই রাজনীতিতে পা রাখেন। এরদোয়ানের দল একেপির হয়ে পার্লামেন্টের সদস্যও হয়েছিলেন। অন্যদিকে তাঁর বিয়েতে যাওয়া আরেক রাজনীতিক গুলেন একটি আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। যেটি ‘গুলেন আন্দোলন’ বা হিজমেত নামে পরিচিত। এটি আসলে বহুজাতিক ইসলামিক ও সামাজিক আন্দোলন।
একসময় একেপি আর গুলেন আন্দোলনের বন্ধুত্বই ছিল। তবে ২০১২ সালে দুই দলের মধ্যে ভাঙন ধরে। দুটি পথ দুই দিকে বেঁকে যায়। ২০১৩ সালে এরদোয়ান সরকার গুলেন আন্দোলনের চালানো ক্রামার স্কুল বন্ধ করে দেয়। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে একেপি থেকে পদত্যাগ করেন সুকুর। সেই থেকেই হয়ে যান এরদোয়ানের বিরাগভাজন। বছর তিনেক পর টুইটারে এরদোয়ান সরকারের সমালোচনা করে পড়েন রোষানলে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে ‘আমি আলবেনিয়ান, তুর্কি নই’ বলে তুরস্কের সাধারণ মানুষের ভালোবাসাও হারিয়েছেন অকুতোভয় ফুটবল খেলার জন্য ‘বুল অব বসফরাস’ নাম পাওয়া সুকুর।
সরকারকে কটাক্ষ করায় ২০১৬ সালের জুনে বিচার শুরু হয় সুকুরের। তুরস্কের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা অবশ্য নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। কিন্তু তাতে লাভ কিছু হয়নি। সুকুরের নামে জারি হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। তাঁকে ‘ফেতুল্লা সন্ত্রাসী সংগঠন’-এর সদস্য বলে ঘোষণা দেয় সরকার।
জীবনের এই ভাঙাগড়ার মাঝেই সুকুর আবার বিয়ে করেন। সুকুর ও বেইদা দম্পতির তিন সন্তান। সন্তানসন্তুতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হয়েছেন, হয়তো সুখেই আছেন। কিন্তু একটি অসুখ কি তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে না? হয়তো আর কোনো দিন ফিরতে পারবেন না জন্মভূমিতে। খেলোয়াড়ি জীবনে তুরস্কের বাইরে খেলতে গেলে দেশের আলো-বাতাস খুব মিস করতেন। একসময় তাঁর ছবি ঝুলত ইস্তাম্বুলের রাস্তায় রাস্তায়, তাঁর নাম থাকত মানুষের মুখে মুখে।
সেই সুকুর এখন বিদেশ-বিভুঁইয়ে। পুরোনো দিনগুলো নিশ্চয়ই তাঁর মনে পড়ে। আর হয়তো ভাবেন, কোথা থেকে কখন যে কী হয়ে গেল! টেলিগ্রাফ।