ফুটবল তো নয় যেন দাবা খেলা...

মেসিকে সব সময় কড়া নজরদারিতে রেখেছেন কান্তে ও আজপিকুয়েলেতা। ছবি: এএফপি
মেসিকে সব সময় কড়া নজরদারিতে রেখেছেন কান্তে ও আজপিকুয়েলেতা। ছবি: এএফপি

• ম্যাচে শতকরা ৭৪ ভাগ সময় বল দখলে ছিল বার্সেলোনার।
• তবে গোলের সুযোগ সৃষ্টিতে এগিয়ে ছিল চেলসি।
• দুই কোচই খেলেছেন ট্যাকটিকসের খেলা।
• দৃষ্টি সুখকর না হলেও কৌশলগত দিক থেকে অনন্য এক ম্যাচ ছিল এটি।

মাঠে পেদ্রোর পজিশন কী? সোজা ভাষায়, ফরোয়ার্ড। আরেকটু নিখুঁত হতে চাইলে বলতে হবে উইঙ্গার। প্রতিপক্ষের রক্ষণে গতি আর ড্রিবলিং দিয়ে ত্রাস ছড়ানোই তাঁর কাজ। তবে যে দর্শক কালই প্রথম এই স্প্যানিয়ার্ডকে দেখলেন, তিনি কিন্তু দ্বিমত করতে বাধ্য। পেদ্রো উইঙ্গার হলে ডিফেন্ডার বলবেন কাকে? বার্সেলোনার বিপক্ষে নিজের অর্ধ ছেড়ে পেদ্রোকে উঠতে দেখা গেছে কয়বার? আঙুলের কর গুনেই বলে দেওয়া যাবে সংখ্যাটা।

অথচ ৩-৪-৩ ফরমেশনে আক্রমণের অন্যতম প্রধান অস্ত্র হওয়ার কথা পেদ্রোর। কাল এই ফরমেশন দিয়ে আসলে ট্রোজানদের লুকিয়ে রেখেছিলেন কন্তে। আটজন মিলে রক্ষণ সামলেছে চেলসির। বক্সে ঢোকার মুখে মেসিদের পাসিং ফুটবলের ঝড়টাকে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। এরপরও বক্সে ঢুকে পড়লে সেখানে পাঁচ-ছয়জনের জটলার সামনে পড়েছেন মেসি-সুয়ারেজরা। কাল বার্সাও আক্রমণভাগে একজনকে কম নিয়ে নেমেছিল। বার্সার ৪-৩-৩ ফরমেশনও আসলে স্রেফ লোক দেখানো। কালকের ম্যাচটা সত্যিই যেন খেললেন দুই কোচ অ্যান্তনীয় কন্তে ও আরনেস্তো ভালভার্দে। মাঠে ফুটবল, আর দুই কোচের মাথায় তখন চলছিল দাবার ছক।

চেলসি ডিফেন্সের সামনে সুয়ারেজও ছিলেন প্রাণহীন। ছবি: রয়টার্স
চেলসি ডিফেন্সের সামনে সুয়ারেজও ছিলেন প্রাণহীন। ছবি: রয়টার্স

অতিরক্ষণাত্মক ফুটবলে সাফল্য পেতে হলে প্রতিটা পাল্টা আক্রমণই নিখুঁত হতে হয়। এমন একজনকে লাগে যিনি মাঝমাঠে বল পেয়ে মুহূর্তেই প্রতিপক্ষের রক্ষণকে এলোমেলো করে দিতে পারবেন। সে কাজটা উইলিয়ান ও হ্যাজার্ডেরই বেশি সাজে। কাল তাই চেলসি নামল কোনো প্রতিষ্ঠিত সেন্টার ফরোয়ার্ড ছাড়াই। উইঙ্গারের খোলসে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার বনে যাওয়া পেদ্রোর বদলি হিসেবে আলভারো মোরাতা তবু মিনিট দশেক হাত-পা ঝাড়ার সুযোগ পেয়েছেন। অন্য স্ট্রাইকার অলিভিয়ের জিরু ডাগ আউটে দর্শক হিসেবেই ছিলেন পুরোটা সময়। কন্তের উদ্দেশ্যই ছিল বল যতটা সম্ভব পায়ে কম রাখা এবং উইলিয়ান ও হ্যাজার্ডকে ব্যবহার করে দ্রুত প্রতি-আক্রমণে ওঠা। চেলসি ম্যাচে যে চারটি সেরা সুযোগ পেয়েছে, সবই শুরু হয়েছে হ্যাজার্ডের মাধ্যমে এবং সেই আক্রমণ শেষ হয়েছে উইলিয়ানকে দিয়ে।

কন্তের বেছে নেওয়া তিন সেন্টারব্যাক ছিলেন রুডিগার, আজপিলিকুয়েতা ও ক্রিস্টেনসেন। অধিনায়ক কাহিলের বদলে ক্রিস্টেনসেনকে বেছে নেওয়াটা অবশ্য উল্টো ফল দিয়েছে ম্যাচ শেষে। এই ড্যানিশ ডিফেন্ডারের ভুল পাস দখলে নিয়েই মেসিকে গোল বানিয়ে দিয়েছেন ইনিয়েস্তা। এর আগ পর্যন্ত অবশ্য ভালোই নিজেদের কাজটা করছিলেন এই তিন ডিফেন্ডার। কারণ, উইংব্যাক হিসেবে থাকা আলোনসো ও মোজেস ছাড়া দুই মিডফিল্ডার কান্তে ও ফ্যাব্রিগাসও ছিলেন রক্ষণকাজে। সঙ্গে দুই উইঙ্গার পেদ্রো ও উইলিয়ানও নিজেদের স্বভাবগত পজিশন থেকে অনেক নিচে খেলেছেন।

পাল্টা আক্রমণে ওঠার চেষ্টা করছেন হ্যাজার্ড। ছবি: রয়টার্স
পাল্টা আক্রমণে ওঠার চেষ্টা করছেন হ্যাজার্ড। ছবি: রয়টার্স

উইংয়ে এভাবে চারজনকে খেলিয়ে কন্তে বার্সেলোনার উইং প্লে খেলার সুযোগ শেষ করে দিয়েছেন। ফলে এ মৌসুমে ভালভার্দের মূল অস্ত্রে রূপ নেওয়া দুই ফুলব্যাক সার্জি রবার্তো ও জর্ডি আলবা আক্রমণে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেননি। বার্সেলোনাকেও তাই মাঠের মধ্যভাগ দিয়েই আক্রমণ করতে হয়েছে। কিন্তু তিন ডিফেন্ডার আর কান্তে-ফ্যাব্রিগাস তো সে অপেক্ষাতেই ছিলেন। মেসি-সুয়ারেজ যখনই বল নিয়ে এগোনোর চেষ্টা করেছেন, তিন চারজন ঘিরে ফেলেছেন তাঁদের। ডি-বক্সের আশপাশে যাওয়ার সুযোগই দেওয়া হয়নি তাঁদের। বার্সেলোনাও নিজেদের গেম প্লে থেকে শট নেওয়ার কোনো সুযোগ পায়নি। নিজেদের মাঝে বল দেওয়া-নেওয়া করে ম্যাচের শতকরা ৭৪ ভাগ সময় তা দখলে রাখাটা সত্যিকার অর্থেই কোনো কাজে লাগেনি।

কাল ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন উইলিয়ান। ছবি: রয়টার্স
কাল ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন উইলিয়ান। ছবি: রয়টার্স

ভালভার্দেও খেলেছেন ট্যাকটিকসের খেলা। এ কারণেই ওউসমানে ডেমবেলেকে প্রায় ৪০ মিনিট ধরে মাঠের পাশে গা গরম করতেই দেখা গেল। কিন্তু মাঠে নামার সময় সুযোগ মিলেছে রাইট উইংব্যাক অ্যালেক্স ভিদালের। মধ্যমাঠ ব্যবহার করে আক্রমণে সুবিধা না হওয়াতেই ভিদালকে মাঠে নামানো। কিন্তু ক্রিস্টেনসেনের ভুলের আগ পর্যন্ত এতেও খুব একটা লাভ হয়নি বার্সেলোনার। শেষ মুহূর্তেও গোলের জন্য বার্সার মধ্যে তেমন মরিয়া ভাব দেখা যায়নি। ভালভার্দে যে এ ফলাফলেই সন্তুষ্ট সেটা বোঝা গেছে শেষ মিনিটের বদলিতে। ডেমবেলকে বসিয়ে রেখে আন্দ্রে গোমেজকে নামিয়েছেন বার্সা কোচ। কারণটা ভালভার্দেই বলেছেন, চেলসির মাঠ কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জায়গা নয়।

এটাই সত্যি, ফুটবলের আদলে যে দাবা খেলা হয়েছে, তাতে যে এক বিন্দু ছাড় দেওয়ার উপায় ছিল না। কন্তের দুর্ভাগ্য, ক্রিস্টেনসেনের কিছুক্ষণের জন্য মনঃসংযোগ হারানোর পাল্টা চাল যে কোনোভাবেই ভেবে রাখা সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে।