এক পরাজিত নায়ক

ঘিরে ধরা সব শঙ্কা আর চাপকে উড়িয়ে মারলেন সাব্বির। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক পরাজিত নায়ক! ছবি: শামসুল হক
ঘিরে ধরা সব শঙ্কা আর চাপকে উড়িয়ে মারলেন সাব্বির। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক পরাজিত নায়ক! ছবি: শামসুল হক

প্রশ্নটা প্রায় প্রতি ম্যাচের আগেই উঠেছে, সাব্বির রহমান একাদশে থাকছেন? একটা ব্যাটসম্যান পরিবর্তন হতে পারে, আর সেটা সাব্বির, এমন পাকা খবরও খুদে বার্তা হয়ে অনুপ্রবেশ করল সফরকারী সাংবাদিকদের মুঠোফোনে। যেভাবে খেলছিলেন, বাদ পড়ার গুঞ্জনটাকে উড়িয়ে দেওয়াও যাচ্ছিল না। পুরো সফরে একমাত্র যে ইনিংসে একটু জ্বলে উঠেছিলেন, তাতেও খোঁটা শুনতে হয়েছে। ভারতের বিপক্ষে আগের ম্যাচে ২৩ বলে ২৭ রানের ইনিংসটায় সাব্বির আরেকটু মেরে খেলতেও তো পারতেন!

সাব্বির শেষ পর্যন্ত আজ একাদশে। দলের ভয়াবহ বিপর্যয় দেখলেন উইকেটে দাঁড়িয়ে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে আস্থার ব্যাটসম্যানটিকে সঙ্গ দিয়ে ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই নিজেই ডেকে আনলেন বিপদ। উইকেটকিপারের হাতে বল, এই অবস্থায় মাহমুদউল্লাহকে ঠেলে দিলেন রানআউটের মুখে! সাব্বিরের দিকে ধেয়ে আসা গিলোটিনটা উঁকি দিচ্ছিল। আর সেই মুহূর্তটাকে সাব্বির বেছে নিলেন ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসটা খেলার জন্য। ৫০ বলে ৭টি চার ও ৪ ছক্কায় ৭৭ করেছেন। বাংলাদেশ ১৪০ রান করলেই বর্তে যায়—এমন ম্যাচে তাঁর ওপর ভর করেই পেয়েছিল ১৬৬ রানের পুঁজি।

সাব্বির অবশ্য বলবেন, এভাবে তো পারতে চাইনি! দল যখন জেতে না, তখন কী লাভ এমন ইনিংস খেলে! বল হাতে নেওয়ার উপায় ছিল না। তবে ভারতের দুটি বড় উইকেটের পতন তাঁর হাতে। তাঁর হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন লোকেশ রাহুল (১৪ বলে ২৪) ও মনীষ পান্ডে (২৭ বলে ২৮)। দুটো ক্যাচই ছিল কঠিন। এর মধ্যে মনীষ যখন ফিরছিলেন, ভারত তখন ১৮ বলে ৩৫ রান দরকার।

আজকের ম্যাচে বাংলাদেশের লাভটাও তাই সম্ভবত সাব্বিরকে ফিরে পাওয়া। সংস্করণটা টি-টোয়েন্টি বলে টিম ম্যানেজমেন্ট ম্যাচের পর ম্যাচ তাঁর ওপর আস্থা রেখেছে। সাব্বির নিজেও বলতে পছন্দ করেন, ‘টি-টোয়েন্টি হচ্ছে আমার খেলা!’ পাওয়ার ক্রিকেট খেলেন, জায়গামতো বল পেলে ক্লিন হিট করতে পারেন, রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে ভীষণ তৎপর, উইকেটে দাঁড়িয়ে গেলে প্রতিপক্ষের বোলারদের স্বস্তিতে থাকতে দেন না একটুও—২২ গজে এ গুণগুলো দেখেই মাশরাফি বিন মুর্তজা তাঁকে সনদ দিয়েছেন ‘ইম্প্যাক্ট’ খেলোয়াড় বলে।

অথচ সাব্বির কিনা দিনের পর দিন বোতলবন্দী হয়ে রইলেন। মাঠের বাইরের নানা অপ্রীতিকর ঘটনায় জড়িয়ে পড়ায় মানসিকভাবেও যেন এলেমেলো। তাঁকে বাদ দেওয়ার রব এতটা তীব্র হয়েছে, হয়তো তাতে আরও হতাশ হয়ে পড়েছেন। মাঠে, মাঠের বাইরে কঠিন এক সময়ই পার করতে হয়েছে সাব্বিরকে। ওয়ানডেতে সর্বশেষ ১১ ইনিংসে ফিফটির দেখা নেই। সর্বশেষ ২৩ ইনিংসে মাত্র দুটি ফিফটি। টি-টোয়েন্টিতে ফিফটির দেখা তো পাচ্ছিলেন না দুই বছর ধরে। ক্যারিয়ারটা নিয়েই সাব্বির বাজি খেলছেন কি না, এমন কথাও উঠে গিয়েছিল।

পুরো নিদাহাস ট্রফিতে তাঁর মুখে হাসি দেখাটা দুর্লভ দৃশ্য মনে হয়েছে! কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিয়েছেন মলিন মুখে। মাঠে ভালো করতে পারছেন না, মানসিক অস্থিরতার কারণে স্বাভাবিক রসিকতাও নিতে পারেননি অনেক সময়। এই যে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুর্দান্ত দুটি জয়ের পর দলের প্রায় সব খেলোয়াড়কে এখানে-ওখানে হাসিখুশি চেহারায় ঘুরতে দেখা গেছে, সাব্বিরকে দেখা যায়নি! কী খবর—এক সাংবাদিক কুশলাদি জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিয়েছেন, খবর তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে! কিছু করলেই সেটি ‘ভাইরাল’ হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, সেটিই বোঝালেন সাব্বির।

চারদিকে নানা সমালোচনা শুনতে শুনতে হাঁপিয়ে ওঠা সাব্বির ১৪ মার্চ ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন, ‘...তোমার একটা মাত্র ভুল জিনিসকে নিয়ে অনেক সমালোচনা করা হবে।...শক্ত হয়ে সব সময় সবার হাসি এবং সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকো। সফলতা আসবেই।’

সাব্বির শক্ত হয়ে থাকার ফল পেয়েছেন আজ। ঘিরে ধরা চাপ সরিয়েছেন, নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। সেটিও বড় মঞ্চে, কত কঠিন পথ পেরিয়ে। তাঁর ভুলে মাহমুদউল্লাহ রানআউট হয়েছেন, ইনিংসটা যদি আজ বড় না করতে পারতেন, নির্ঘাত সাব্বিরকে চড়তে হতো সমালোচনার শূলে। সাব্বির তখন ৪২ রানে ব্যাট করছিলেন, জানতেন তাঁকেই টেনে নিতে হবে, যতটা পারেন।

সাব্বির পেরেছেন। পাহাড়বোঝা টেনেও। কিন্তু পারলেন কই! এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখতে রাখতেই যে পা হড়কাল বাংলাদেশের!