কমনওয়েলথে দেশের প্রথম সোনাজয়ীর কষ্ট

কমনওয়েলথে প্রথম সোনাজয়ী শুটার আতিকুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
কমনওয়েলথে প্রথম সোনাজয়ী শুটার আতিকুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

আবদুল্লাহ হেল বাকী মনে করিয়ে দিলেন আজ থেকে ২৮ বছর আগের কথা!

১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাস বাংলাদেশের খেলার ইতিহাসে দারুণ একটি সময়। নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে কমনওয়েলথ গেমসে সেবারই যে প্রথম পদক জয় করেছিল বাংলাদেশ। প্রথমে ব্রোঞ্জ, এরপর একেবারে সোনা। শুটিংয়ে ১০ মিটার এয়ার পিস্তল ইভেন্টে ব্রোঞ্জের সঙ্গে সোনা জিতে দেশকে আনন্দে ভাসিয়েছিলেন আবদুস সাত্তার নিনি আর আতিকুর রহমান।

সাফ গেমসের মতো আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় সোনার পদক জয়ের অভিজ্ঞতা আমাদের ছিল, কিন্তু কমনওয়েলথের মতো বৈশ্বিক আসরে প্রথম জাতীয় সংগীত বাজার গৌরব অনেকের কাছেই ছিল অবিস্মরণীয় এক ঘটনা। সেদিন অনেক স্বপ্ন এসে ভিড় করেছিল বাংলাদেশের ক্রীড়াপ্রেমী মানুষের মনে। কমনওয়েলথ গেমসের পর, এশিয়ান গেমস, অলিম্পিক—আমরা এগিয়ে যাব। আরও অনেক বড় সাফল্য এসে ধরা দেবে বাংলাদেশের হাতে। কিন্তু ২৮ বছরে সে স্বপ্ন এখনো বহুদূরের পথ।

অস্ট্রেলিয়ার গোল্ডকোস্টে কমনওয়েলথ গেমসের ১০ মিটার এয়ার রাইফেল ইভেন্টে আবদুল্লাহ হেল বাকী যখন অল্পের জন্য সোনা হাতছাড়া করলেন, তখন তাঁর পূর্বসূরি আতিকুর রহমানের কণ্ঠে আফসোস!

আফসোস অবশ্যই বাকী সোনা জেতেননি বলেই। সেই সঙ্গে আফসোসটা থাকল দেশের ক্রীড়া ব্যবস্থাপনা নিয়েই, ‘এত বড় প্রতিযোগিতায় আমরা যে জিততে পারি, সেটা তো নিনি ভাই (আবদুস সাত্তার) আর আমি ১৯৯০ সালেই দেখিয়েছিলাম। এরপর কত বছর কেটে গেল। আমরা সেই সাফল্যকে ভিন্ন স্তরে নিতে পারলাম না। এশিয়ান গেমস কিংবা অলিম্পিক—এই দুটি বড় আসরেও আমরা সাফল্য পেতাম, যদি আমাদের নীতিনির্ধারকেরা যত্নশীল হতেন।’

আতিকুর রহমান অবশ্য নিজে দেশকে আরও সাফল্য উপহার দিয়েছেন। ১৯৯৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সাফ গেমস কিংবা ১৯৯৫ সালে মাদ্রাজ সাফে (এখন চেন্নাই) একাধিক সোনা জিতেছেন—ব্যক্তিগত ও দলগত। কিন্তু সাফল্যটাকে কেন যেন আরও বড় পরিসরে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না। 

ব্যাপারটা আতিককে পোড়ায় সব সময়ই, ‘কমনওয়েলথ গেমস বড় প্রতিযোগিতা, সন্দেহ নেই। কিন্তু এশিয়ান গেমস অনেক কঠিন। এখানে পদক জেতা মানে অলিম্পিকেই পদক জেতা। এশিয়াডে আমাদের শুটারদের লড়তে হয় চীন, জাপান, কোরিয়ার প্রতিযোগীদের সঙ্গে। এঁরাই অলিম্পিক মাতায়। আমি মনে করি, কিছু টেকনিক্যাল জায়গায় আমরা পিছিয়ে পড়ি।’

কমনওয়েলথে প্রথম সোনাজয়ে আতিকের সহযোদ্ধা ছিলেন আবদুস সাত্তার নিনি। ছবি: সংগৃহীত
কমনওয়েলথে প্রথম সোনাজয়ে আতিকের সহযোদ্ধা ছিলেন আবদুস সাত্তার নিনি। ছবি: সংগৃহীত

আতিকের মতে, সবচেয়ে বড় পিছিয়ে থাকার জায়গাটা হচ্ছে পৃষ্ঠপোষকতা, ‘চীন, জাপান, কোরিয়া এমনকি ভারতেও ব্যক্তিগত খেলার একজন ক্রীড়াবিদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব হয় না। কিন্তু আমাদের এখানে একজন শুটার কিংবা, সাঁতারুকে খেলা ছাড়াও তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অজস্র বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়। ভবিষ্যৎ সুসংহত নয় বলেই আমাদের এখানে বাকী কিংবা আসিফরা নিজেদের অন্য স্তরে নিতে পারে না।’
১৯৯০ সালে অকল্যান্ড কমনওয়েলথ গেমসে সেই সোনার পদকটা অপ্রত্যাশিত ছিল, সেটা জানালেন আতিকই। কিন্তু সেই সোনার পদক যে শুটিংয়ের একটা শক্ত ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল, সে জন্য গর্বই অনুভব করেন তিনি, ‘সেবার কেউই আশা করেনি আমরা দুটি পদক পাব। ১০ মিটার এয়ার পিস্তলে ব্রোঞ্জ জেতাটাই অনেক কিছু ছিল, কিন্তু আমরা ব্রোঞ্জের পাশাপাশি জিতে গেলাম সোনা। আমরা অকল্যান্ডে বেশ কিছু দিন আগে গিয়েছিলাম, মনে আছে। তবে আমি বলব সাফল্যে নিনি ভাইয়ের ব্যক্তিগত কিছু উদ্যোগের খুব ভূমিকা ছিল। এয়ার পিস্তল ইভেন্টের লড়াই করার কিছু ম্যানুয়েল তিনি বিদেশ থেকে আনিয়েছিলেন। সেটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর আর্থিক সংগতির কারণেই। আমরা গুলশান শুটিং রেঞ্জে সেসব দেখে দেখে অনুশীলন করতাম। নিনি ভাই বলতেন, অন্য দেশের প্রতিযোগীরা যদি পারে, তাহলে আমরা পারব না কেন! ওদের মতো আমাদেরও তো দুটি হাত দুটি পা। বুদ্ধিবৃত্তিতেও আমরা কম নই। সেই সাফল্য আমাদের দেশের শুটিংয়ের চেহারা পাল্টে দিয়েছিল। বেশ কিছু সম্ভাবনাময় শুটার তৈরি হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতায় আমরা পরের প্রায় প্রতিটি সাফ গেমসেই শুটিংয়ে সোনা জিতেছি। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, আমরা কখনোই একটা গণ্ডির বাইরে যেতে পারিনি।’
কমনওয়েলথ গেমসে এখনো পর্যন্ত ৬টি পদক পেয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৯০ সালে অকল্যান্ড গেমসে একটি ব্রোঞ্জ আর একটি সোনার পর দীর্ঘ এক যুগের একটা বন্ধ্যা সময় গেছে বাংলাদেশের জন্য। ১৯৯৪ সালে ভিক্টোরিয়া কিংবা ১৯৯৮ সালে কুয়ালালামপুর গেমসে আসেনি একটি পদকও। এরপর অবশ্য প্রতিটি কমনওয়েলথেই বাংলাদেশ পদকের তালিকায় ছিল। ২০০২ সালে ম্যানচেস্টারে আসিফ হোসেন খান সোনা জিতেছিলেন। এরপর ২০০৬ সালে মেলবোর্ন, ২০১০ সালে দিল্লি ও ২০১৪-তে গ্লাসগো গেমসে শুটিংই ছিল আমাদের ভরসা। মেলবোর্নে একটি রুপা ও একটি ব্রোঞ্জের পর দিল্লিতে একটি ব্রোঞ্জ ও গ্লাসগোয় একটি রুপা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় বাংলাদেশকে। গ্লাসগোয় বাকীই দেশের জন্য রুপা জিতে এনেছিলেন। এবার একই ইভেন্টে সেটি সোনা হলে আনন্দটা আরও অনেক বেশিই হতে পারত।
২০০২ সালে ম্যানচেস্টার কমনওয়েলথ গেমসে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে সোনাজয়ী আসিফ হাসান খান হারিয়েছিলেন ভারতের প্রতিযোগী অভিনব বিন্দ্রাকে। সেই বিন্দ্রাই ৬ বছর পর বেইজিং অলিম্পিকে সোনা জেতেন। আসিফ হারিয়ে যান দৃশ্যপট থেকে। কমনওয়েলথে দেশের হয়ে প্রথম সোনাজয়ী আতিকের কষ্টটা অনুভব করার জন্য এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কী হতে পারে!