বাকিকে নিয়ে নাহয় আশায় থাকি

আবদুল্লাহ হেল বাকিকে নিয়ে অলিম্পিকের একটা পদকের স্বপ্ন তো দেখাই যায়। ছবি: প্রথম আলো
আবদুল্লাহ হেল বাকিকে নিয়ে অলিম্পিকের একটা পদকের স্বপ্ন তো দেখাই যায়। ছবি: প্রথম আলো
>টানা তিনটি কমনওয়েলথ গেমসে পদক জিতলেন আবদুল্লাহ হেল বাকি। পরপর দুটি ব্যক্তিগত রুপা। গোল্ডকোস্টে এবারের গেমসে তো সোনা জেতেননি অল্পের জন্য। বড় মঞ্চে ধারাবাহিক বাকিকে নিয়ে আরও বড় স্বপ্ন তো দেখা যায়ই। ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিক গেমসই নাহয় লক্ষ্য হোক!

২০১০ নয়াদিল্লি কমনওয়েলথ গেমসে আসিফ হোসেনকে নিয়ে দ্বৈতে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন। ২০১৪ গ্লাসগো কমনওয়েলথ গেমসে নাম লেখালেন এককভাবে। আবদুল্লাহ হেল বাকি এবার জিতলেন ব্যক্তিগত রুপার পদক। চার বছর পর ২০১৮ গোল্ডকোস্টে রুপার পদকটিকে সোনালি রঙে রাঙাতে চেষ্টার কমতি রাখেননি। কিন্তু হলো না মাত্র দশমিক ৩১ পয়েন্টের ব্যবধানে।

কমনওয়েলথ গেমস মানেই আবদুল্লাহ হেল বাকির জন্য ১০ মিটার এয়ার রাইফেলের একটি পদক বরাদ্দ। কিন্তু সেটির রং কিছুতেই সোনালি হচ্ছে না। সোনার হাহাকার বাকির ঘুচল না। ১ ও ২-এর মধ্যে যে ব্যবধান, সোনা-রুপাতেও তাই। আসলে দূরত্ব আলোকবর্ষের।

তবে বাকি এই ধারাবাহিকতায় এই ইচ্ছেটা অন্তত জানিয়ে দিতে পেরেছেন, এখনো তিনি সোনার জন্য স্বপ্নচারী। চার বছর পরপর কমনওয়েলথ গেমসে গর্জে ওঠে বাকির রাইফেল। তাহলে ২০২২ বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমসে আসছে সোনার পদক? বাকির এখন ২৮ চলছে, বার্মিংহামে বয়স হবে ৩২। শুটিং শারীরিক শক্তির খেলা নয়, লক্ষ্যভেদের খেলা। তবু অন্য খেলার মতো তিরিশ পেরোলে এখানেও যেন অস্তাচলে যায় সামর্থ্য। তবে বাংলাদেশের শুটিং অঙ্গন গোল্ডকোস্টের বেলমন্ট শুটিং রেঞ্জে যে বাকির দেখা পেল সেই বাকি আত্মপ্রত্যয়ী। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে তাঁকে টপকে শিরোপা জিতে গেছে এক তরুণ, অনুজ্জ্বল ছিলেন অনুশীলনেও। এই বাকিকে নিয়ে কেউ বাজি ধরেনি। ডেনিশ কোচ ক্রিস্টেনসেন ক্লাভস তাঁকে ১০ মিটার রেঞ্জে দাঁড় করিয়ে দিয়ে খেলেছিলেন একটা ফাটকা। আর বাকি কিনা এনে দিলেন রুপা। তাও সোনাজয়ী অস্ট্রেলিয়ান শুটার ডেন সিম্পসনের সঙ্গে মাত্র দশমিক ৩০ পয়েন্ট পিছিয়ে থেকে। ইশ্‌, শেষ শটটিতে মনঃসংযোগ একটু টলে না গেলেই হতো! রুপাটা রূপ নিত সোনায়।

এতে ৭১টি জাতীয় পতাকার এই গেমসে বাংলাদেশ পেত নিজেদের সেরা সাফল্য। বাকির সোনার পদকের সঙ্গে শাকিলের রুপা মিলিয়ে পদক হতো দুটি। দুই শুটারের কল্যাণে এখনো বাংলাদেশের সেরা সাফল্যের স্মৃতি হয়ে আছে ২৮ বছর আগের ১৯৯০ অকল্যান্ড কমনওয়েলথ গেমস। সেবার এয়ার পিস্তলে আতিকুর রহমান ও আবদুস সাত্তার দ্বৈতে সোনার পদক জিতে ফ্রি পিস্তলের দ্বৈতে জিতেছিলেন ব্রোঞ্জ।

বাকি গোল্ডকোস্টে সোনা জিতলে তাঁকেই কি বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা রাইফেল শুটার বলা হতো? হয়তো, হয়তো বা না। টানা তিনটি কমনওয়েলথ গেমসে পদক জিতে এমনিতেই তিনি দেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা শুটার হয়ে গেছেন। এই মুহূর্তে দেশের সেরা বললেও তাঁকে সর্বকালের সেরা রাইফেল শুটার বলতে দ্বিধান্বিত বাংলাদেশের শুটিং সমাজ। সাফ গেমসের সোনাজয়ী শুটার ও অভিজ্ঞ শুটিং কোচ সৈয়দ আসবাব আলীর মতে দেশের সেরা রাইফেল শুটার এখনো আসিফ, ‘আসিফের মতো প্রতিভাবান শুটার এখন পর্যন্ত দেখিনি। ২০০২ কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জেতার পর ওর অনেক দূর যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ও নিজেই নিজের সম্ভাবনাকে নষ্ট করেছে।’ তবে বাকির মানসিক দৃঢ়তার প্রশংসা ঝরেছে আসবাব আলীর মুখে, ‘বাকি মানসিকভাবে শক্ত। ও ভালো চাইলেই ভালো স্কোর করতে পারে।’

এক সময় দেশসেরা রাইফেল শুটার বলা হতো সাইফুল আলম চৌধুরী রিংকিকে। ১৯৯৪ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত অংশ নিয়েছেন ৪টি কমনওয়েলথ গেমসে। সাফ গেমসে একক ও দলগত মিলিয়ে তাঁর সোনার পদক পাঁচটি, সাফ শুটিংয়ে ছয়টি। বাংলাদেশের সেরা রাইফেল শুটারের নির্বাচনে নির্দিষ্ট কারও দিকে যায়নি সাইফুলের রায়। ‘আমি নিজেও শুটার ছিলাম। দেশের হয়ে অনেকগুলো সোনা জিতেছিও। কে সেরা এটি তো বলবেন অন্যরা। আসিফ কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জিতেছে। বাকি পরপর দুটি কমনওয়েলথ গেমসে রুপা জিতল, বিরাট অর্জন। তবে সত্যটা হলো ১০০টি রুপা বা ব্রোঞ্জ জিতলেও একটি সোনার সমান তা হয় না’—বলেছেন সাইফুল।

সাইফুলের স্ত্রী বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা নারী শুটার সাবরিনা সুলতানা অবশ্য রাখঢাক করেননি। তাঁর চোখে এই মুহূর্তে সেরা রাইফেল শুটার অবশ্যই আবদুল্লাহ হেল বাকি। যদিও বাংলাদেশের এযাবৎকালের সেরা হিসেবে সাফ গেমসে দুটি, সাফ শুটিংয়ে ছয়টি এবং কমনওয়েলথ শুটিংয়ে একটি সোনাজয়ী শুটার আসিফেরই নাম বলেছেন। সাবরিনার মূল্যায়নে বাংলাদেশের সেরা তিন রাইফেল শুটারের ক্রমটা এ রকম—আসিফ, রিংকি (সাইফুল) ও বাকি। আসিফের মতো প্রতিভাবান হয়তো নন, কিন্তু টানা দুটি কমনওয়েলথ গেমসে রুপাজয়ী শুটারের মধ্যে বিশেষ কিছু একটা আছেই। কী সেটা? সাবরিনা বলেন, ‘বাকির ম্যাচ টেম্পারামেন্ট খুব ভালো। আসল সময়ে ও লড়াকু।’

আগের গেমসে দেশের হয়ে একমাত্র পদকজয়ী বলে কুচকাওয়াজে তাঁর হাতেই থাকার কথা ছিল জাতীয় পতাকা। গোল্ডকোস্টে বাকির হাতেই দুলেছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ। উদ্বোধনী-সমাপনী দুই অনুষ্ঠানেই। কাল রাতে ঘরে ফেরা বাংলাদেশ দলের মধ্যমণি ছিলেন আবদুল্লাহ হেল বাকি। মুখে উজ্জ্বল হাসি। হাসিটা পরবর্তী অলিম্পিকের আসর টোকিও ২০২০ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে না?

বাংলাদেশের সাবেক শুটারদের যেমন ধারণা, তাতে হতেই পারে। আরেকটি বিষয় তো আমাদের জানাই। কমনওয়েলথ গেমসের ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে রুপা জিতে অলিম্পিকে সোনাও জেতা যায়। ২০০২ ম্যানচেস্টার কমনওয়েলথ গেমসে রুপাজয়ী ভারতের অভিনব বিন্দ্রা ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে সেটি দেখিয়েছেন। ম্যানচেস্টারের সোনাজয়ীর নাম আসিফ হোসেন!

বাংলাদেশের শুটিংয়ের এক উচ্চাশার নাম আসিফ, হতাশার নামও আসিফ। এখন দেখার বাকি আবদুল্লাহ হেল বাকিকে—তাঁকে নিয়ে না হয় একটি অলিম্পিক পদকের আশায় থাকি। সোনা নয়, রুপাও নয়, ব্রোঞ্জ হলেও চলবে। বাংলাদেশ যে এখন পর্যন্ত অলিম্পিক পদকহীন বিশ্বের একমাত্র বৃহত্তম দেশ।