জেলখানা এখন ফুটবল মাঠ

দুঃসময় ভুলে রাকা স্টেডিয়ামে খেলায় মেতেছেন ফুটবলাররা। ছবি: এএফপি
দুঃসময় ভুলে রাকা স্টেডিয়ামে খেলায় মেতেছেন ফুটবলাররা। ছবি: এএফপি

এই রাকা স্টেডিয়ামই একসময় তাঁর ঠিকানা ছিল। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বন্দী হয়ে এই স্টেডিয়ামের নিচটাতেই কাটত তাঁর সময়। ‘মুক্ত’ আজিজ আল-সাজের আরও একবার রাকা স্টেডিয়ামে ফিরেছেন। এবার ফুটবলকে সঙ্গী করে।

স্থানীয় ফুটবল দলগুলো নিয়ে সিরিয়ার শহর রাকায় আয়োজন করা হয়েছে একটি টুর্নামেন্ট। আল-রশিদ ফুটবল দলের হয়ে ওই টুর্নামেন্টে খেলতেই রাকা স্টেডিয়ামে ফেরা ২৫ বছর বয়সী সাজের ও তাঁর সতীর্থদের। গায়ে সাদা আর উজ্জ্বল হলুদে মেলানো জার্সি। হালকা গা গরমের অনুশীলন শেষে সাজেররা নেমে পড়লেন রৌদ্র-তপ্ত মাঠে।
জনা পঞ্চাশেক দর্শকও জড়ো হয়েছিলেন ফুটবলারদের উৎসাহ দিতে। স্টেডিয়ামের যে জায়গাটাতে তাঁরা ভিড় করেছিলেন, ঠিক তার নিচের ঘরগুলোকেই আইএস রূপান্তরিত করেছিল ভয়ংকর এক জেলখানায়।
সতীর্থদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আগে, আশপাশে তাকিয়ে সাজের যেন ফিরে গেলেন অতীতে। মনে করলেন নিজের বন্দিদশার কথা। আইএসের হাতে জিজ্ঞাসাবাদের নামে এখানেই যে কাটিয়েছেন জীবনের ভয়ংকরতম এক মাস! তবে সেই স্মৃতি ভুলে এখন চোখ সামনে। শোনালেন আশার কথা, ‘এই যে পেছনের জেলটা, ওটা আমার অতীত। সবকিছু চুকে গেছে। এখন শান্তিতে বাঁচার সময়।’

মাঠে নামছেন খেলোয়াড়েরা, স্টেডিয়াম এখনো ধরে রেখেছে সেই সব ভয়াবহ দিনের চিহ্ন। ছবি: এএফপি
মাঠে নামছেন খেলোয়াড়েরা, স্টেডিয়াম এখনো ধরে রেখেছে সেই সব ভয়াবহ দিনের চিহ্ন। ছবি: এএফপি

তিন বছর ধরে রাকা আইএসের দখলে ছিল। এই সময় আইএস ইসলামি অনুশাসন প্রতিষ্ঠার নামে মানুষের জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছিল স্বাভাবিকতা। সেই সময়টাতে ফিরে গিয়েই যেন সাজের বললেন, ‘আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে খেলতাম তখন। খেলার ব্যাপারটা ঠিক নিষিদ্ধ ছিল না। তারা এটা পছন্দ করত না। তবে বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ-এ রকম কোনো দলের লোগোওয়ালা জার্সি পরা নিষেধ ছিল। এই অপরাধে জেলও হতে পারত।’ খেলার অপরাধে জেল। সেটাও আবার কোথায়। একটা স্টেডিয়ামে!
মাঠের আশপাশে এখনো বুলেটের খোসা পাওয়া যায়। আর স্টেডিয়ামের ঠিক নিচে টিমটিমে আলোয় নোংরা দেয়ালগুলো দেখতে তেমন একটা সমস্যা হয় না। সেখানেই কোনো দুর্ভাগা বন্দীর ‘ঈশ্বর, আমাদের সাহায্য করুন’ লেখাটা যেন জ্বলজ্বল করতে থাকে।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্স (এসডিএফ) রাকা থেকে আইএসকে উৎখাতে তীব্র যুদ্ধে জড়ায়। পিছু হটতে থাকা আইএসের সর্বশেষ ঘাঁটিগুলোর একটি ছিল এই রাকা স্টেডিয়াম। ছয় মাস পর ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়ে সেই মাঠে প্রাণ ফিরেছে। এই টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছে রাকা সিভিল কাউন্সিল (আরসিসি)।
আইএস-উত্তর যুগে এটিই রাকার প্রথম কোনো ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ, জানিয়েছেন আরসিসির ক্রীড়া ও যুব কমিটির সহসভাপতি নশোয়া রমজান। আর এই টুর্নামেন্ট দিয়েই নতুন দিনের স্বপ্ন বুনছেন রমজান, ‘আমরা খেলাকে স্টেডিয়ামে ফিরিয়ে এনেছি। আইএস চলে গেছে। আর সঙ্গে নিয়ে গেছে আমাদের ভয়। আমরা এখন মেয়েদের খেলাধুলা নিয়েও পরিকল্পনা করছি।’

ফুটবলারদের উৎসাহ দিতে জড়ো হয়েছেন দর্শক। যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, ঠিক তার নিচের ঘরগুলোকেই আইএস রূপান্তরিত করেছিল ভয়ংকর এক জেলখানায়। ছবি: এএফপি
ফুটবলারদের উৎসাহ দিতে জড়ো হয়েছেন দর্শক। যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, ঠিক তার নিচের ঘরগুলোকেই আইএস রূপান্তরিত করেছিল ভয়ংকর এক জেলখানায়। ছবি: এএফপি

রাকা স্টেডিয়ামে ফুটবলে ফেরার ম্যাচে আল-রশিদের প্রতিপক্ষ ছিল আল-সাদ। রাকার কাছের শহর তাবকার দল আল-সাদ। মাঠে খেলোয়াড়েরা বলের পেছনে ছুটছে আর গ্যালারি থেকে ভেসে আসছে দর্শকদের উল্লাস-হর্ষধ্বনি। ‘আল-সাদ, আল-সাদ, চতুর্থ গোলটা হচ্ছে না কেন?’ এক সমর্থকের ব্যাকুল জিজ্ঞাসা। আরেক দর্শক ‘দারুণ, দারুণ’ বলে চিৎকার করছিলেন।
ওই উচ্ছ্বসিত দর্শকদের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদ আল-হারুনি। রাকায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরতে দেখে যিনি আবেগাপ্লুত, ‘ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও আমরা আশাবাদী ছিলাম, সময়ের সঙ্গে একদিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। এই ম্যাচটাই তার প্রমাণ।’