যে অভিশাপ থেকে মুক্তি না পেলে বিশ্বকাপ জিতবে না আর্জেন্টিনা!

তিলকারার অভিশাপ এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আর্জেন্টিনাকে! (ছবি - ফিফা)
তিলকারার অভিশাপ এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আর্জেন্টিনাকে! (ছবি - ফিফা)
>শুধু মেসি, দিবালা বা আগুয়েরোদের নৈপুণ্যে নয়, বিশ্বকাপ জিততে হলে আর্জেন্টিনাকে মুক্তি পেতে হবে এক অভিশাপ থেকেও!

সেই যে ১৯৮৬ তে বিশ্বকাপ জিতল ডিয়েগো ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা, তার পরে তো কত কিছুই হলো। প্রাচীর ভেঙে দুই জার্মানি এক হলো, সাতাশ বছর জেলে থাকার পর মুক্তি পেয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন নেলসন ম্যান্ডেলা, ব্রাজিল আরও দুইবার বিশ্বকাপ ঘরে তুলল, যুগোস্লাভিয়া ভেঙে গেল—কিন্তু আর্জেন্টিনা আর একবারের জন্যও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে পারল না!
ম্যারাডোনার পরে বাতিস্তুতা, আইমার, ক্রেসপো, ক্যানিজিয়া, ওর্তেগা, রিকুয়েলমে—কত প্রতিভাই তো এলেন–গেলেন, তাও কিছুতেই কিছু হলো না। ১৯৯০ আর ২০১৪ বিশ্বকাপে ফাইনালে উঠলেও শেষ পর্যন্ত খালি হাতেই ফিরে আসতে হয় আকাশি-সাদাদের। দলে ম্যারাডোনা-উত্তর যুগের সবচেয়ে বড় তারকা লিওনেল মেসি থাকা সত্ত্বেও বিশ্বকাপের আরেকটি শিরোপা ঘরে তুলতে পারেনি আর্জেন্টিনা। এই রহস্যের গোড়া কোথায়?
এই আর্জেন্টিনা দলে প্রতিভার অভাব নেই, মেসি-দিবালা, আগুয়েরো-হিগুয়েইন, ডি মারিয়া-পাভন–সমৃদ্ধ দলটি অবশ্যই বিশ্বকাপ জেতার দাবি রাখে, তাঁদের সেই প্রতিভাও রয়েছে। কিন্তু উত্তর আর্জেন্টিনার এক প্রত্যন্ত গ্রাম তিলকারার বাসিন্দা ডেভিড গোর্দিয়ো ও সারা ভেরার মতে, তিলকারার অভিশাপ থেকে মুক্তি না পেলে আর্জেন্টিনা আর কখনোই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে পারবে না, তা দলটা যতই প্রতিভায় ভাস্বর হোক না কেন!
কী এই তিলকারার অভিশাপ? জানতে একটু পেছনে যাওয়া যাক!
১৯৮৬ বিশ্বকাপের দামামা বাজছে, সেবার বিশ্বকাপ হচ্ছে মেক্সিকোয়। মেক্সিকোর প্রতিকূল আবহাওয়া ও ভূপৃষ্ঠ থেকে উঁচুতে অবস্থিত মাঠে খেলতে যাতে আর্জেন্টাইনদের সমস্যা না হয়, সে কারণে তৎকালীন আর্জেন্টিনা কোচ কার্লোস বিলার্দো চাইলেন এমন এক জায়গায় বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নিতে, যেখানকার আবহাওয়া মেক্সিকোর আবহাওয়ার মতন। চারদিকে খোঁজ পড়ে গেল। কোথায় মিলবে এখন মেক্সিকোর মতো উঁচু মাঠ ও প্রতিকূল আবহাওয়ার জায়গা?
বেশি দূর যেতে হলো না। আর্জেন্টিনার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে এক প্রত্যন্ত গ্রামের সন্ধান পাওয়া গেল, যার আবহাওয়া অনেকটা মেক্সিকোর মতো এবং যা ভূপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৫০০ মিটার উঁচুতে। ছোট সেই গ্রামটা আধুনিক অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকেই বঞ্চিত ছিল তখন, পুরো গ্রামে টেলিভিশন খুঁজলেও পাওয়া যেত না। টেলিফোন ছিল মোটে একটা। তবুও গ্রামের লোকজন রেডিও শুনে আর পত্রপত্রিকা পড়ে নিজেদের জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের চিনেছিল। এখন সেই গ্রামে নিজেদের জাতীয় বীরেরা আসবেন অনুশীলন করতে, বুঝতেই পারছেন, সে গ্রামে কী রকম সাজ সাজ রব পড়ে গিয়েছিল তখন! যদিও দলের অধিনায়ক ডিয়েগো ম্যারাডোনা যাননি সেই অনুশীলন ক্যাম্পে, কিন্তু তা–ও, গ্রামবাসীর মধ্যে আগ্রহের কমতি ছিল না কোনো।
সেই গ্রামের বেশ কিছু খেলোয়াড়কে বিলার্দো জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে অনুশীলন করার সুযোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যেই একজন ডেভিড গোর্দিয়ো। এই গোর্দিয়োই তখন কথায় কথায় জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের বলেছিলেন ‘ভার্জিন অব কোপাকাবানা’ মূর্তির কথা। গ্রামের একমাত্র গির্জায় আছে সেই মূর্তি, এই মূর্তির সামনে শুদ্ধ মনে যে যা মানত করে, তাই বলে সে পায়। তবে একটা শর্ত আছে, মানত করতে গিয়ে কেউ যদি কোনো প্রতিশ্রুতি করে, তাহলে মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ার পরে সে প্রতিশ্রুতি রাখতে হয়, না হলে নেমে আসে অভিশাপ!
গ্রামের এই উপকথা এল কুসংস্কারাচ্ছন্ন কোচ কার্লোস বিলার্দোর কানে। যার মাঠ ভাড়া করে অনুশীলন করছিল আর্জেন্টিনা, সেই সারা ভেরা আর ডেভিড গোর্দিয়োকে দিয়ে ব্যবস্থা করিয়ে সেই গির্জায় প্রার্থনা করে এলেন কার্লোস বিলার্দো। সারা ভেরার মতে, কার্লোস বিলার্দো ভার্জিন অব কোপাকাবানার ছবির সামনে বিড়বিড় করে বলেছিলেন, তাঁর বিশ্বকাপ জেতার মনোবাসনা যদি পূর্ণ হয়, তবে তিনি নিজে আবার সেই গির্জায় ফেরত গিয়ে হাঁটু গেড়ে ধন্যবাদ জানাবেন ভার্জিন অব কোপাকাবানাকে!
সেবার পশ্চিম জার্মানিকে ফাইনালে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জেতে আর্জেন্টিনা। কিন্তু এরপর আর বিশ্বকাপ ট্রফি ছোঁয়া হয়নি তাদের— বিলার্দো যে তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি! ভার্জিন অব কোপাকাবানার সামনে হাঁটু গেড়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেননি।
কার্লোস বিলার্দোকে পরে এ নিয়ে যতবারই জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, স্রেফ অস্বীকার করেছেন তিনি। তাঁর মতে, তিলকারার বাসিন্দারা তাঁদের গ্রামের পর্যটনশিল্পকে সমৃদ্ধ করার জন্যই তাঁর নাম ব্যবহার করছেন। ওদিকে সেই বিশ্বকাপে খেলা আর্জেন্টিনার ডিফেন্ডার অস্কার গ্যারের বলেন, ‘আমাদের তিলকারায় যেতে কোনো সমস্যা নেই। তারা অনেক অতিথিবৎসল ছিল, আমাদের বেশ সেবাযত্নও করেছিল। কিন্তু আমরা কোনো ধরনের কোনো প্রতিশ্রুতি দিইনি সেখানে গিয়ে।’
বিলার্দো আর গ্যারে যতই অস্বীকার করুন না কেন, একটা শিরোপা জেতার তাড়নায় মরিয়া আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশন ২০০৬ বিশ্বকাপের আগে বিশ্বকাপের একটা প্রতিরূপ আরেকটা স্মারক পাঠিয়েছিল সে গির্জায়। তাতে লাভ হয়নি কোনো, বিশ্বকাপ জেতেনি আর্জেন্টিনা, সেই জার্মানির কাছেই কোয়ার্টার ফাইনালে পেনাল্টিতে হেরে চোখের জলে বিদায় নেন মেসি-ক্যাম্বিয়াসোরা।
কয়েক দিন পরে তাই মেসি-ম্যাচেরানোদের তিলকারায় যাওয়ার খবর শুনলে চমকে উঠবেন না যেন!