সাকিব ও তাঁর বাবার ফুটবল-জীবন

মাগুরা স্টেডিয়ামে বাবা মাশরুর রেজার কাছ থেকে ফুটবলের তালিম নিচ্ছে ছোট্ট সাকিব। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে
মাগুরা স্টেডিয়ামে বাবা মাশরুর রেজার কাছ থেকে ফুটবলের তালিম নিচ্ছে ছোট্ট সাকিব। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

ছেলেকে ফুটবলের কারিকুরি শেখাচ্ছেন বাবা—ছবিটা যে মাগুরা স্টেডিয়ামে তোলা, সেটি বলতে পারলেন। তবে কবে তোলা, বলা একটু কঠিনই হলো খন্দকার মাশরুর রেজার। অনেক আগের কথা, স্মৃতিতে ধুলা পড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। তবে বহুদিন পর এই ছবিটার যে পুনরাবৃত্তি হবে সেটি নিশ্চয়ই ভাবেননি মাশরুর।

১২ ফেব্রুয়ারি, মাঘের পড়ন্ত বিকেল। জানুয়ারিতে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে আঙুলের যে চোটে পড়েছিলেন সেটি পুরোপুরি সেরে না ওঠায় সাকিব আল হাসানের খেলা হচ্ছে না শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজটাও। এমনই মন খারাপের বিকেলে কন্যা আলায়না হাসানকে নিয়ে চলে এলেন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে। শৈশবে বাবা মাশরুর রেজার কাছে যেমন মাগুরা স্টেডিয়ামের সবুজ গালিচায় ফুটবলের কারিকুরি শিখতেন, সাকিব সেটিই যেন করতে চাইলেন নিজের মেয়ের সঙ্গে। সময়ের ব্যবধানে কী দারুণভাবে মিলে গেল ছবি দুটি! ফুটবলের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কটা যে আসলেই আত্মিক, ছবি দুটি যেন সে কথাই বলে।

বাবা চেয়েছিলেন সাকিব ফুটবলার হোক
বাবা চেয়েছিলেন সাকিব ফুটবলার হোক

আজ ক্রিকেট নয়, কথা হবে ফুটবল নিয়ে—শুনে মাশরুর রেজা বেশ খুশি হলেন। এবং যে হাসিটা দিলেন সেটির মর্মার্থ, ‘মোক্ষম সময়েই দুয়ারে কড়া নেড়েছেন, ফুটবল নিয়ে কথা বলার অপেক্ষাতেই ছিলাম!’

মাশরুর রেজা একসময় ছিলেন ফুটবলার। জেলা-বিভাগীয় পর্যায়ে দাপটের সঙ্গে ফুটবল খেলেছেন। ক্যারিয়ারের শুরুতে ফরোয়ার্ড পজিশনে, ধীরে ধীরে চলে আসেন রক্ষণভাগে। স্বপ্ন ছিল, একদিন জাতীয় দলে খেলবেন। সেই স্বপ্নপূরণ হয়নি। স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে হয়েছেন ব্যাংকার। তবে নিজ হাতে গড়ে তুলেছেন ভাগনে মেহেদী হাসান উজ্জ্বলকে। উজ্জ্বল খেলেছেন বাংলাদেশ ফুটবল দলে। চেয়েছিলেন ভাগনের পর নিজের ছেলেকেও বানাবেন দুর্দান্ত ফুটবলার। সে-ও খেলবে জাতীয় দলে। তবেই না নিজের অপূর্ণ স্বপ্নটা সত্যি হবে পুরোপুরি!

ছেলে তাঁর জাতীয় দলে খেলছেন। এক যুগ ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন। দেশের সবচেয়ে বড় তারকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তবে ছেলে ফুটবলার হননি, হয়েছেন ক্রিকেটার। ক্রিকেটেই যে অর্জন তাঁর ছেলের, তিনি ফুটবলার কেন হননি সেই আফসোস এখন আর পোড়ায় না মাশরুর রেজার, ‘আমাদের দেশে একসময় সামির শাকির, এমেকার মতো বড় তারকা ফুটবলার খেলতে এসেছে। এখন সেটি দেখাই যায় না। দেশের ফুটবলের মান আগের মতো নেই। ভালো মানের ফুটবলারও নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে ফুটবল নিয়ে চেষ্টা করি, যদি মাগুরা থেকে ভালো কোনো ফুটবলার বের হয়। আমার অনেক ছাত্র জাতীয় দলে খেলেছে। আগের মতো কোচিংয়ে সময় দিতে পারি না। তবুও কেউ যদি আমার কাছে আসে চেষ্টা করি।’

মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে মেয়ে আলায়নার সঙ্গে সাকিব, তাঁদের সঙ্গী ফুটবল। ছবি: শামসুল হক
মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে মেয়ে আলায়নার সঙ্গে সাকিব, তাঁদের সঙ্গী ফুটবল। ছবি: শামসুল হক

এটা সত্য, মাশরুর রেজা একটা সময় মোটেও চাননি সাকিব ক্রিকেটার হন। ফুটবলের প্রতি অসীম ভালোবাসা তো ছিলই। নব্বইয়ের দশকেও বাংলাদেশে ফুটবলের মান যে উঁচুতে ছিল, ফুটবলাররা যে মর্যাদা পেতেন, মাশরুরের চাওয়া ছিল খেলোয়াড় যদি হতেই হয় সাকিব চর্মগোলকটা নিয়ে আলো ছড়াক সবুজ আয়তক্ষেত্রে, ‘আমি চেষ্টা চালিয়েছিলাম ওকে ফুটবলার বানাতে। ক্রিকেট তখন এতটা রমরমা অবস্থায় ছিল না। ভাগনে জাতীয় দলে খেলেছে। আমার কাছ থেকেই সে প্রাথমিক তালিম নিয়েছে। ভেবেছিলাম, লেখাপড়ার পাশাপাশি সাকিব যদি ফুটবল খেলতে চায় খেলুক।’

বাবা ফুটবলার ছিলেন, ফুফাতো ভাই জাতীয় ফুটবল দলে খেলেছেন। ফুটবল-ঘনিষ্ঠ একটি পরিবারে বড় হয়েও ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নটা কীভাবে দেখলেন সাকিব? পিতা-পুত্রের কাছ থেকে প্রায় একই উত্তর। সাকিবেরটাই আগে শুনুন, ‘মনে হয় বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জেতার পর ক্রিকেটার হওয়ার ইচ্ছেটা জাগে।’ মাশরুরও একমত, ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জেতাটা যে বাংলাদেশের বহু কিশোরের মনে যে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিল, সাকিব তাঁদের একজন।

তবে শুরুতে সাকিবকে ক্রিকেট খেলতে হতো বাবার অগোচরে। মাশরুর রেজা টের পেলে বেজায় খেপতেন! মাগুরার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তখন চলত ফুটবল বনাম ক্রিকেটের ‘লড়াই’। লড়াইটা বাবা বনাম ছেলের স্বপ্নেরও। এই লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছেন দেখে খেপে গিয়ে মাশরুর রেজা সাকিবকে মারধর করেছেন, ব্যাট পর্যন্ত কেটে ফেলেছেন! সাকিব বিখ্যাত হওয়ার পর এ গল্প অবশ্য অনেকবার লেখাও হয়েছে। তবে স্মৃতিগুলো মনে পড়লে এখন বড্ড হাসি পায় মাশরুরের, ‘ক্রিকেট যেহেতু সারা দিনের খেলা, পড়াশোনায় ক্ষতি হবে বলে অনেক বাধা দিয়েছি। মারধর, ব্যাট কাটাকাটি অনেক কিছুই হয়েছে। ফুটবল খেলে না বলে আরও বেশি ব্যাট কেটেছি!’ বাবা চেয়েছিলেন ছেলেকে ফুটবলার বানাবেন, তাই বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ক্রিকেটার হওয়া কতটা কঠিন ছিল সাকিবের পক্ষে? ‘কঠিন ছিল না। ক্রিকেটার হওয়ার পথে বাধা হয়নি ফুটবল। পরিবার সমর্থন করেছে। আমি যেভাবে চেয়েছি সেভাবেই হয়েছে’—বাংলাদেশ টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়কের আপাতসহজ ব্যাখ্যা।

সাকিবের মতো আলায়নাও ফুটবল পছন্দ করে
সাকিবের মতো আলায়নাও ফুটবল পছন্দ করে

ক্রিকেটার হলেও ফুটবলের প্রতি সাকিবের ভালোবাসায় কমতি নেই। সেই ভালোবাসা কতটা একবার আড্ডায় বলছিলেন বিকেএসপির জনসংযোগ কর্মকর্তা আশরাফুজ্জামান। বিকেএসপিতে একটা প্রীতি ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করা হয়েছিল। সেই ম্যাচে খেলবেন বলে সাকিব ইংল্যান্ড থেকে প্রায় লাখ টাকা দিয়ে বুট কিনে এনেছিলেন। যে বুট পরে সাধারণত বিশ্বের শীর্ষ ফুটবলাররা খেলেন।

ফুটবলের প্রতি কেবল ভালোবাসাই নয়, সাকিবের ফুটবল-প্রতিভাও মুগ্ধতা-জাগানিয়া। কন্ডিশনিং ক্যাম্প কিংবা ওয়ার্মআপে বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়েরা যখন দুই ভাগে ভাগ হয়ে ফুটবল খেলেন, সাকিবের ড্রিবলিং, পাসিং, ফিনিশিং দেখে মোহাবিষ্ট হয়ে যান অনেকেই। সতীর্থদের সঙ্গে ওয়ান-টু খেলে বক্সে ঢুকে দুর্দান্ত ফিনিশিং—দেশের ক্রিকেট তারকাদের ভিড়ে সাকিবের ফুটবলশৈলী আলাদা করে নজরে পড়বেই।

ছুটিতে মাগুরায় গেলে মাঝেমধ্যে ফুটবল নিয়ে নেমে পড়েন বাবার সঙ্গে। সাকিবের ফুটবল-প্রতিভা দেখে আজও মাশরুর রেজার মনে পুরোনো ইচ্ছেটা জেগে ওঠে, ‘মাগুরায় এলে কখনো আমার দলে খেলে, কখনো আমার বিপক্ষে। ওর খেলা দেখে আমার অনেক বন্ধু বা পরিচিত কোচরা বলেন, যদি ও ফুটবল খেলত তাহলেও মনে হয় জাতীয় দলে খেলত!’

পেশাদার ফুটবলার হননি, নিয়মিত ফুটবল অনুশীলনও করতে হয় না, তবু এই অসাধারণ ফুটবল-নৈপুণ্য সাকিব দেখান কীভাবে? বাংলাদেশ অলরাউন্ডার যে একটি রহস্যের হাসি হাসবেন সেটি কি আর বলতে! তবে উত্তরটা দিলেন এভাবে, ‘ছোটবেলা থেকে অনেক খেলাই আমি ভালো খেলি। তবে ফুটবলে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে খেলতে ভালো লাগে।’

সাকিব যে অন্য খেলার কথা বললেন, এর মধ্যে শুধু ফুটবলই নয়, ব্যাডমিন্টনও আছে। মাশরুর রেজা সাকিবের ব্যাডমিন্টন-প্রতিভা সম্পর্কেও আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘জায়গায় দাঁড়িয়ে সে দুই হাতেই ব্যাডমিন্টন খেলতে পারে। এত দ্রুত হাত বদলাতে পারে, দেখে মুগ্ধ হয়ে যাবেন। কিছু খেলোয়াড় থাকে গড গিফটেড। সাকিবও তা-ই। ও শিখে খেলোয়াড় হয়নি, পুরোটাই সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত।’

বাবা-ছেলে যখন এক জায়গায় হন, খেলা নিয়ে দুজনের আলোচনা হয় কম। যেহেতু সামনে ফুটবল বিশ্বকাপ, এই উত্তাপ তাঁদের স্পর্শ করবেই। হয়তো কথায় কথায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাও চলে আসবে। হবে মধুর তর্ক। বলে নিই, মাশরুর রেজা ব্রাজিল-অন্তঃপ্রাণ। পছন্দের খেলোয়াড় ব্রাজিলের রোনালদো, রোনালদিনহো। এই সময়ের খেলোয়াড়দের মধ্যে পছন্দ করেন মেসি-নেইমার দুজনকেই। সাকিবের প্রিয় দল আর্জেন্টিনা, প্রিয় খেলোয়াড় লিওনেল মেসি। এবার অবশ্য বিশ্বকাপের মধ্যেই বাংলাদেশ দলের খেলা পড়েছে। এ মাসের শেষ দিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যাচ্ছে বাংলাদশে। তাই নিবিড়ভাবে নয়, ক্রিকেটের ফাঁকে ফাঁকে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে হবে সাকিবকে।

এবার বিশ্বকাপে প্রিয় দল ব্রাজিলের সম্ভাবনা কতটা দেখছেন মাশরুর? তিনি বেশ আশাবাদী, ‘ব্রাজিল সমর্থন করি, আশাবাদী তো অবশ্যই। সমর্থন করি না-করি আর্জেন্টিনা দলকেও ভালো বলতে হবে।’ তা সাকিব আর্জেন্টিনার সম্ভাবনা কতটা দেখছেন? বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার আপাতত নিরুত্তর!