শুরুতেই টালমাটাল বিশ্বকাপ

পরপর দুই দিন একই হতাশা দুই মহানায়কের। শনিবার আইসল্যান্ডের সঙ্গে ড্রয়ের পর আর্জেন্টিনার মেসি, রোববার সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ড্রয়ের পর ব্রাজিলের নেইমার।  ছবি: এএফপি
পরপর দুই দিন একই হতাশা দুই মহানায়কের। শনিবার আইসল্যান্ডের সঙ্গে ড্রয়ের পর আর্জেন্টিনার মেসি, রোববার সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ড্রয়ের পর ব্রাজিলের নেইমার। ছবি: এএফপি

জার্মানিকে ১-০ গোলে হারিয়ে দিয়ে মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে উল্লাস করেছে মেক্সিকো। গ্যালারিতে সবুজের ঢেউ ছড়িয়ে দিয়েছে মেক্সিকান-সমর্থকেরা। সারা রাত ধরে মস্কোর রাস্তায় রাস্তায় তারা নেচেছে, গেয়েছে। মেক্সিকানদের আনন্দ-উল্লাস জার্মানদের কাছে হতাশার। আর গোটা বিশ্বকাপের জন্যই যেন একটা কাঁপুনি।

প্রথম দুটি দিন কেটেছিল ভালোয় ভালোয়, তৃতীয় দিনে এসে প্রথম ঝাঁকুনি সাড়ে তিন লাখের কম মানুষের দেশ আইসল্যান্ডের সঙ্গে আর্জেন্টিনা ড্র করে বসায়। আর পরদিন বিশ্বকাপ যেন কোনো এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ খুলে দিল। মস্কোয় জার্মানির হারের কয়েক ঘণ্টা পর সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ব্রাজিলের অপ্রত্যাশিত ড্র। জার্মানির হার, আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের ড্র—ফেবারিট-তত্ত্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই কি এগোবে ২১তম বিশ্বকাপ?

বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মুকুট মাথায় পরে আগের তিনবার বিশ্বকাপে খেলতে নেমে প্রথম ম্যাচে জার্মানি কখনো হারেনি। ১৯৫৮ সালে ৩-১ গোলে হারায় আর্জেন্টিনাকে, ১৯৭৮ বিশ্বকাপে গোলশূন্য ড্র করে পোল্যান্ডের সঙ্গে, ১৯৯৪ সালে বলিভিয়ার বিপক্ষে জেতে ১-০ গোলে। এই বোবা পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝানো যাবে না, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা এবার কতটা ফেবারিট হয়ে নেমেছিল প্রথম ম্যাচে। মাত্রই এক বছর আগে, এই রাশিয়াতেই, বলতে গেলে বাচ্চা ছেলেদের একটি জার্মান দল কনফেডারেশনস কাপের সেমিফাইনালে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল মেক্সিকোকে। তারাই ফাইনালে দক্ষিণ আমেরিকার চ্যাম্পিয়ন চিলিকে হারিয়ে জিতে নেয় শিরোপা। এক বছর পর বিশ্বকাপে এসে সেই জার্মানি আর বাচ্চাদের দল তো নয়। বিশ্বজয়ী কয়েকজন খেলোয়াড় ঢুকে দলটিকে দিয়েছে প্রায় অজেয় চেহারা। আর তারাই কিনা হেরে গেল বিশ্বকাপের নিয়মিত ভ্রমণপিয়াসী দল মেক্সিকোর কাছে!

অপ্রত্যাশিত তো বটেই। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে সব ম্যাচ জিতে যোগ্যতামান পেরিয়েছে জার্মানি। তার ওপর তাদের দলে রয়েছে আশ্চর্য রকম গভীরতা। অনেকেই বলাবলি করেন, জার্মানি এবার বিশ্বকাপে দুটি দল দিতে পারত। চূড়ান্ত দল থেকে লিরয় সানের মতো খেলোয়াড়কে বাদ দেওয়ার পর জার্মান কোচ জোয়াকিম লো বলেছিলেন, ‘দুঃখ লাগছে যে আমার দল যেভাবে আমি সাজিয়েছি, সেখানে লিরয় সানেকে জায়গা দিতে পারলাম না।’ এই লো নিজেও জার্মানির এক শক্তির উৎস। জার্মানিকে একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে লোর অবদানও কম নয়।

সেই জার্মানিই কিনা মেক্সিকোর হাতে কুপোকাত প্রথম ম্যাচে! রেফারি শেষ বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছেন, জার্মানির হারটা অলৌকিক সত্য বলে মনে হচ্ছে, রোস্তভের প্রেস সেন্টারে পাশে বসা জার্মান সাংবাদিক একটা গালি দিয়ে উঠে চলে গেলেন। অনেক জার্মান সাংবাদিক ফাইনালে ব্রাজিলকে তাঁদের সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ ধরে নিয়ে অনুসরণ করছেন ব্রাজিলকে। স্মেলজার তাঁদেরই একজন। জার্মানির হারটা তাঁর কাছে অবিশ্বাস্য। আর মেক্সিকো যে গতির তোড়ে জার্মানিকে এভাবে ভাসিয়ে দিতে পারে, তাঁর কল্পনায়ও ছিল না।

কিন্তু বাস্তবতা কল্পনাকে ছাড়িয়ে গেল। এখন তো দেখা যাচ্ছে রাশিয়া বিশ্বকাপ একটু তির্যক দৃষ্টিই হানছে ফেবারিট দলগুলোর দিকে। ১৬ জুন স্পার্তাক মস্কো স্টেডিয়ামে আইসল্যান্ড তাদের বিশ্বকাপ অভিষেক উদ্‌যাপন করল আর্জেন্টিনার সঙ্গে ড্র করে। জার্মানির হারের তিন ঘণ্টা পর ব্রাজিলকে রোস্তভ অ্যারেনায় রুখে দিল সুইজারল্যান্ড। বিশ্বকাপে ফেবারিটদের ভাগ্যটা টলমল করছে কি না, কে বলতে পারে। এর মধ্যে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় দিনই আরেক ম্যাচে দুই ফেবারিট মুখোমুখি হয়ে সোচিতে একটি ফুটবল মহাকাব্য রচনা করেছে। রোনালদোর হ্যাটট্রিকে অপেক্ষাকৃত বড় ফেবারিটের সঙ্গে ড্র করেছে ছোট ফেবারিট পর্তুগাল। তবে আইবেরিয়ান এই ডার্বিকে তো আর অঘটন বলা যাবে না। এটি স্বাভাবিক ফল। জিততে পারত যেকোনো দল। স্পেনের জয়টাকে শেষ মুহূর্তে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে রোনালদোর জাদু।

ইংল্যান্ড-বেলজিয়ামকেও গোনায় ধরছেন অনেকে। এই দুই দলই মাঠে নেমেছে গতকাল। সোচিতে নবাগত পানামার সঙ্গে বেলজিয়াম কী করেছে কিংবা ভোলগাগ্রাদে তিউনিসিয়ার বিপক্ষে ইংল্যান্ড, এতক্ষণে সেটি আপনাদের জানা হয়ে গেছে।

কিন্তু ইংল্যান্ড ও বেলজিয়াম হলো দূরতর ফেবারিট। জার্মানি, ব্রাজিল, স্পেন বা আর্জেন্টিনার পর তালিকাটা লম্বা করতে গেলে এই দুটি নাম আসবে। ব্রাজিল, জার্মানি, আর্জেন্টিনার শুরুটা ভালো না হলেই বিশ্বকাপে কোত্থেকে যেন একটা আশঙ্কার বাতাস উড়ে আসে, আসতে চায় আরকি। সেটি আসতে শুরু করেছে।

দোন নদীর তীরের রোস্তভ অ্যারেনা স্টেডিয়াম এখন শান্ত। কোলাহল নেই। দর্শক-সমর্থক নেই। শুধু দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন নিরাপত্তারক্ষীরা। এই স্টেডিয়ামেই ফুটবলের আধ্যাত্মিক সদর দপ্তর ব্রাজিলকে নাড়িয়ে দিয়েছে ফিফা সদর দপ্তরের দেশ সুইজারল্যান্ড। তার তিন ঘণ্টা আগে মহামতি লেনিনের মূর্তিকে সাক্ষী রেখে মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে একটি বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে মেক্সিকো। 

বাস্তবতা এখন এমন যে ফেবারিট জার্মানি, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার কাছে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় ম্যাচ এত গুরুত্বপূর্ণ আগে কখনো হয়ে ওঠেনি। ২৩ জুন সোচিতে জার্মানি তাদের দ্বিতীয় ম্যাচে মুখোমুখি হবে সুইডেনের। দ্বিতীয় ম্যাচে ব্রাজিল সেন্ট পিটার্সবার্গে কোস্টারিকার সামনে দাঁড়াবে ২২ জুন। ২১ জুন আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় ম্যাচের পরীক্ষা নিঝনি নোভগোরাদে, প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়া।