কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা লাগতেও পারে মিঠা

জার্মানিকে হারিয়ে দেওয়া গোলের পর লোজানো। ছবি: রয়টার্স
জার্মানিকে হারিয়ে দেওয়া গোলের পর লোজানো। ছবি: রয়টার্স

নুন খাবারকে যতই সুস্বাদু করুক না কেন, তা যদি কাটা ঘায়ে লাগে, তার জ্বলুনি কিন্তু অসহ্য। অন্যকে এই জ্বালায় জ্বলতে দেখে কেউ কেউ মজা পেলেও যে সয়, সে বোঝে এর যাতনা। যেমনটা দারুণ ও নিদারুণ বিশ্বরাজনীতির ইতিহাস; বিশ্বকাপে চারবারের শিরোপাধারী জার্মানির কাছে তো অবশ্যই।

পাঠক, এতক্ষণে হয়তো ভাবছেন, এই লোকটা বিশ্বকাপের মাঠে লবণ ছিটাতে শুরু করল কেন? কেউ হয়তো বলবেন, লোকটা ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গাইছে। কিন্তু আমি বলব, বিষয়টি মোটেই সে রকম কিছু নয়। বিশ্বকাপের সঙ্গে অবশ্যই লবণের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। যেমন খেলোয়াড়েরা যখন খেলেন, তখন তাঁদের শরীর থেকে ঘামের সঙ্গে প্রচুর লবণ ও পানি বেরিয়ে যায়। সেই বেরিয়ে যাওয়া পানি ও লবণের ঘাটতি পূরণের জন্য তাঁদের বিশেষ খাবার গ্রহণ করতে হয় এবং খেলা চলাকালে ঘন ঘন পানি পান করতে হয়। সেটা না করলে বিশ্বকাপের মাঠে দাপিয়ে বেড়ানো তাবৎ শক্তিমান খেলোয়াড়কে যাবতীয় শক্তি খুইয়ে দুর্বল হয়ে হাসপাতালে গমন করতে হতো।

এবার আসি আসল কথায়। গত রোববার রাতে মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে আন্ডারডগ মেক্সিকোর কাছে ধরাশায়ী হয়েছে এবারের অন্যতম ফেবারিট দল জার্মানি। খেলাটি মস্কোতে না হয়ে যদি ভলগোগ্রাদে হতো, তাহলে চা বা কফির টেবিলের, কিংবা ভিন্ন কোনো আড্ডা বা আসরের আলোচনাটা কেমন হতো? হলফ করে বলা যায়, আড্ডাবাজেরা ও গণমাধ্যমগুলো এতক্ষণে আঙুলে থুতু লাগিয়ে ইতিহাসের পাতা ওলটাতে ওলটাতে ৭৫ বছর আগে ফিরে যেত। কারণ, ১৯৪৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অ্যাডলফ হিটলারের নাজি বাহিনী ওই ভলগোগ্রাদেই বিধ্বস্ত হয়েছিল রাশিয়ার কাছে। আর ওই পরাজয়ের মধ্য দিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল হিটলারের বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। বাধ্য হয়েছিলেন আত্মহননের পথ বেছে নিতে।

এবার আমরাও কিছুক্ষণের জন্য ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলিয়ে আসতে পারি।
হিটলার স্বপ্ন দেখতেন সোভিয়েত রাশিয়া দখলের। এর মূল কারণ রাশিয়ার বিশাল ভূখণ্ড ও তেলের খনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাজি বাহিনী পশ্চিম ইউরোপকে পদানত করে ১৯৪১ সালের ২২ জুন রাশিয়া আক্রমণ করে। সেই আক্রমণের নাম ‘অপারেশন বারবারোসা’। সেই অপারেশনে ছিল ৪০ লাখের বেশি পদাতিক সৈন্য, কয়েক লাখ অশ্বারোহী, আড়াই হাজার বিমান, তিন হাজার ট্যাংক, সাত হাজার কামান আর লক্ষাধিক মোটরযান।

যুদ্ধের মাত্র কয়েক দিনের মাথায় নাজি বাহিনী রাশিয়ার ইউক্রেন দখল করে ৩০০ মাইল ভেতরে ঢুকে পড়ে। নভেম্বরে দখল করে নেয় রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ শহর ভলগোগ্রাদ। ভলগা নদীর তীরের এই শহরের নাম তখন ছিল স্ট্যালিনগ্রাদ। রাশিয়ার তখনকার প্রেসিডেন্ট যোসেফ স্তালিন নিজের নাম অনুসারে শহরটির নাম রেখেছিলেন। ১৯৪৩ সালের নভেম্বরের শুরুতে নাজি বাহিনী স্ট্যালিনগ্রাদকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে শহরের কেন্দ্রে অবস্থান নেয়। ১৯ নভেম্বর সোভিয়েত রাশিয়ার লালফৌজ স্ট্যালিনগ্রাদকে ঘিরে ফেলে। এতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে নাজি বাহিনী। অভাব দেখা দেয় অস্ত্র ও খাবারের। একই সঙ্গে তীব্র শীত ও তুষারপাতে কাবু হয়ে পড়ে নাজিরা। মারা পড়ে কয়েক লাখ সৈন্য। প্রাণ বাঁচাতে আত্মসমর্পণ করে তারও বেশি সৈন্য। পাঁচ মাসের যুদ্ধ শেষে আত্মসমর্পণ করে জার্মানি। মূলত এই পরাজয়ের মধ্য দিয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজি বাহিনীর পরাজয়ের ষোলোকলা পূর্ণ হয়।

এবার আসা যাক বিশ্বকাপের পাটে। রোববার মস্কোতে মেক্সিকোর হারভিং লোজানোর গোল শুধু জার্মানিকে নাড়িয়ে দেয়নি; কাঁপিয়ে দিয়েছে নিজের দেশ মেক্সিকোকেও। সেখানে নাকি দর্শকের দাপাদাপিতে দুই মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে গেছে। তবে মেক্সিকোর এই জয় আরও দারুণ এবং জার্মানির পরাজয় আরও নিদারুণ হতে পারত, যদি খেলাটি ভলগোগ্রাদে হতো। সে ক্ষেত্রে বিষয়টি জার্মানির কাছে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতোই কষ্টকর হতো। লেখা হতো আরও একটি পরাজয়ের ইতিহাস।

খেলাটি যে ভলগোগ্রাদে হয়নি, সে জন্য জার্মানি ফিফা কর্তৃপক্ষের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে পারে। এবং সেই কৃতজ্ঞতা হওয়া উচিত অশেষ। কারণ, গ্রুপে জার্মানির পরের খেলাটি হবে সোচিতে ২৩ জুন। খেলবে সুইডেনের বিপক্ষে। আর গ্রুপের শেষ খেলাটি খেলবে ২৭ জুন কাজানে দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে। যদিও জার্মানির খেলার মাঠ নির্বাচন নিয়ে রসিকেরা নানা রকম রসিকতা করে যাচ্ছেন। এর যৌক্তিক কারণও আছে। সাধারণত বিশ্বকাপের কোনো গ্রুপের সব কটি দলের খেলা কাছাকাছি ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হয়। যেমন আর্জেন্টিনা, ক্রোয়েশিয়া, আইসল্যান্ড ও নাইজেরিয়ার খেলা হচ্ছে মস্কো, নিজনি নভগোরদ ও সেন্ট পিটার্সবার্গে। মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গের দূরত্ব ৭০০ কিলোমিটার এবং নিজনির দূরত্ব মাত্র ৪১৭ কিলোমিটার।

অথচ এফ গ্রুপে জার্মানির দ্বিতীয় খেলার ভেন্যু সোচি থেকে মস্কোর দূরত্ব ১ হাজার ৬৩৪ কিলোমিটার। ভেন্যুটি অনায়াসে ভলগোগ্রাদ হতে পারত। কারণ, মস্কো থেকে এই শহরের দূরত্ব ৯৬৯ কিলোমিটার। জার্মানির জায়গায় অন্য কোনো দল হলে এ ধরনের ভেন্যু হয়তো আপত্তিই করে বসত। জার্মানি সম্ভবত করেনি। এবং সম্ভবত এ জন্য জার্মানি ফিফার কাছে কৃতজ্ঞও।