আজ যদি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা থাকত!

মস্কোভস্কি রেল জংশনের উল্টো দিকের রাস্তা ধরে এগোতে এগোতে মনে হলো, কী সজ্জন-ভদ্র সমর্থক এরা! মাথায় ফ্রান্সের লাল-নীল-সাদা পতাকার রঙের টুপি পরা মাথায়। কারও মাথায় বেলজিয়ামের পতাকার রঙের। বেলজিয়ামেরই কোনো সমর্থক আবার মাথায় পরেছেন রক্ত লাল রঙের বড় টুপি। ‘রেড ডেভিলস’ বলে পরিচিত বেলজিয়াম দলের সঙ্গে মিলিয়ে। কারও গায়ে ফ্রান্সের পতাকা, কারও গায়ে বেলজিয়ামের।

একটা স্রোতে মিশে সবাই চলেছে সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়ামের দিকে। কোথায় সেই চিৎকার, কোথায় উদ্দাম গানের কোরাস? আজ যদি ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা খেলত সেমিফাইনালে ছবিটা হতো অন্য রকম। সেন্ট পিটার্সবার্গের মেট্রোর বগিগুলো টের পেত। আকস্মিক ভূমিকম্পের মতো কেঁপে কেঁপে উঠত রেলগাড়ি। যেমন দেখা গিয়েছিল গ্রুপ পর্বে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনার জয়ে কিংবা ব্রাজিল কোস্টারিকাকে হারিয়ে দেওয়ার পর।

বেলজিয়ামের এক সমর্থক মাথায় লাল মোরগের মতো ঝুঁটি বেঁধে একবার জোরে চিৎকার করলেন, বেলজিয়াম! সেই শব্দ প্রতিধ্বনি তুলে মিলিয়ে গেল। তাঁর হাতে ধরা একটা ব্যানার, উই আর রেড টুগেদার—আমরা আজ একসঙ্গে সবাই লাল।

তা বেলজিয়ামের সবার আজ উত্তেজনায় লালই তো হওয়ার কথা। ৩২ বছর পর সেমিফাইনালে। ফ্রান্সের বাধাটা পেরোলেই ফাইনাল। তারপর কে বলতে পারে নবম দেশ হিসেবে ট্রফিটা বেলজিয়ামের হাতে উঠবে না!

সর্বশেষ ১৯৮৬ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে বেলজিয়াম চূর্ণ হয়েছিল ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনার হাতে। তারপর তৃতীয় স্থান নির্ধারণী খেলায় হারতে হয়েছিল আজকের প্রতিপক্ষ ফ্রান্সের কাছে। সেই প্রতিশোধ নিতে পারবে আজ বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্ম? বেলজিয়ামের কোচ রবার্তো মার্টিনেজ আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ফুটবলে আসলে প্রতিশোধ বলে কিছু নেই। যা আছে তা নিজেদের দিনে ভালো খেলার চেষ্টা করা। ভালো খেললে হয়তো জয়-পরাজয় আসে।

ঠিক, বেলজিয়াম হয়তো প্রতিশোধের নেশায় মত্ত নয়, বরং বলা যেতে পারে নতুন স্বপ্নকে তাড়া করে ছুটছে।

আর ফ্রান্স? তাদের স্বপ্ন নিজেদের ইতিহাসকে আরেকটু সমৃদ্ধ করা। বিশ্ব ফুটবলকে অনেক কিছু দেওয়া ফ্রান্সের হয়তো আরও আগেই শিরোপা জেতা উচিত ছিল। সেটি তারা জেতে গত শতাব্দীর একেবারেই শেষ লগ্নে। ১২ বছর আগে ফাইনালে গিয়ে ক্যাবিনেটে দ্বিতীয় ট্রফিটা রাখা যায়নি অল্পের জন্য। ফরাসিদের আজও পোড়ায় তাদের ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় জিনেদিন জিদানের সেই ক্ষণিকের পাগলামি। ইতালির ডিফেন্ডার মার্কো মাতেরাজ্জিকে ঢুস মেরে লালকার্ড যদি না পেতেন জিজু, সেবারই দ্বিতীয় ট্রফি জেতা হয়ে যায়।

তবে ফ্রান্স দলটি এবার সেমিফাইনাল পর্যন্ত যেমন প্রতিভায়-প্রতিজ্ঞায়-আকাঙ্ক্ষায় এককাট্টা হয়ে এসেছে, তাতে মনে হয় রাশিয়া থেকেই নিয়ে যাবে দ্বিতীয় ট্রফি। সেমিফাইনালে ফ্রান্স সম্ভাবনার পাল্লায় একটু হলেও এগিয়ে। কিন্তু বেলজিয়াম খুবই অননুমেয় দল। কী হয়, বলতে পারছে না কেউ। এমনকি সেন্ট পিটার্সবার্গের ফ্যান ফেস্ট সংলগ্ন হার্মিটেজ জাদুঘরের অ্যাকিলিস নামের কালো বিড়ালটিও কিছু বলতে পারেনি। যেটির ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী রাশিয়া পৌঁছে গিয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনালে।

আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের বিদায়ে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ বলতে গেলে শেষ হয়ে গেছে অনেক আগে। অবশিষ্ট যেটুকু আছে তা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখে যাওয়ার। কিংবা ফুটবলের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা থেকে উৎসারিত আগ্রহ। রাশিয়ায় দেখা যাচ্ছে তা-ই। অনেক রুশ দর্শকই স্টেডিয়ামে যাবে। টিকিট কাটা আছে। বিশ্বকাপ ম্যাচের সাক্ষী হওয়া ইতিহাসের অংশ হওয়ারও সুযোগ। কিন্তু যার সঙ্গেই কথা বলি, মনে হয় না কারও নির্দিষ্ট কোনো পছন্দ আছে। ক্রিস্তিনা নামের এক গৃহবধূ টিকিট কিনে নতুন ফ্যান আইডি নিয়ে ফিরছিলেন আইডি সেন্টার থেকে। কাকে সমর্থন করবেন আজ? এমন প্রশ্নে সরল হাসিতে উত্তর দিলেন, ‘ঠিক জানি না। আমার স্বামীর সঙ্গে খেলা দেখতে যাবে তো, সে-ই ঠিক করবে কাকে সমর্থন দেওয়া যায়। তবে যে দল জিতবে সেই দলেরই বোধ হয় সমর্থক হব আমরা।’

স্যামসানোভা হোটেলের পাশে একটি জর্ডানের রেস্তোরাঁ আছে, সেটির শর্মা খুব বিখ্যাত। ওই হোটেলের দুই কর্মী টস করে ঠিক করবেন কোনো দলের অনুসারী হবেন তাঁরা। তৃতীয় কর্মী বললেন, ‘বেলগিয়াম’। রুশদের মুখে বেলজিয়াম বেলগিয়াম হয়ে যায়।
তবে এটা ঠিক, খেলার মাঠে বেলজিয়াম বেলজিয়ামই থাকবে। স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। যেমন করে রণকৌশলের চাতুর্য দেখিয়ে কোচ রবার্তো মার্টিনেজ এত দূর টেনে এনেছেন দলকে। আগেই বলেছিলেন দুর্দান্ত ফ্রান্সের বিপক্ষেও প্রয়োজনমতো ছক বদলাতে পিছু হটবেন না তিনি।

বেলজিয়াম যদি বেলজিয়ামের মতো থাকে, প্রতিশ্রুতি আছে ফ্রান্সও থাকবে নিজেদের মতো। আর্জেন্টিনাকে গতি আর পাল্টা আক্রমণে উড়িয়ে দেওয়া ফ্রান্স। উরুগুয়েকে সহজেই ধরাশায়ী করা ফ্রান্স।

সত্যি করে বললে, টুর্নামেন্টের সেরা দুটি দল পড়ে গেল একই সেমিফাইনালে। একটিকে আজ গভীর রাতে বিদায় নিতে হবে দুঃখের সঙ্গে।

স্টেডিয়াম লাগোয়া মেট্রো স্টেশনে যখন পৌঁছানো গেল, ফ্রান্সের একটি সমর্থক দলকে গলায় সুর তুলে দেখা গেল এগিয়ে যেতে—আলে লে ব্লুজ, আলে লে ব্লুজ!

নভোযানের আদলে তৈরি সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়ামে শেষে নীল শতদল ফুটবে না রক্তলাল গোলাপ?