ক্রোয়েশিয়াকে টুপি-খোলা অভিনন্দন তাদেরও

সেরা সাফল্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে ক্রোয়েশিয়াকে। ছবি: রয়টার্স
সেরা সাফল্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে ক্রোয়েশিয়াকে। ছবি: রয়টার্স
>

যুগোস্লাভিয়া ভেঙে জন্ম নিয়েছিল ক্রোয়েশিয়াসহ কয়েকটি দেশ। দেশগুলোর রাজনৈতিক ইতিহাস রক্তাক্ত। ওই দেশগুলো কীভাবে দেখছে ক্রোয়েশিয়ার এই সাফল্য?

যুগোস্লাভিয়া ভেঙে ক্রোয়েশিয়াসহ যেসব দেশের জন্ম, সেই প্রতিবেশী দেশগুলো এখন প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছে ক্রোয়েশিয়াকে। রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠা দলটিকে নিয়ে উচ্ছ্বাসের বন্যা বয়ে চলেছে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপজুড়ে। ‘যুগোস্লাভিয়া না ভাঙলে কী অসাধারণ দলই না হতো’ বলে যে দীর্ঘশ্বাস আজও ঘুরপাক খায় আটলান্টিক উপকূলে, সেটা বোধ হয় চাপা পড়ে গেছে এই উৎসবের জোয়ারে। বসনিয়া বা সার্বিয়ার খেলোয়াড়দের ছাড়া তো রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে ক্রোয়েশিয়া!

তবু এখনো কেউ যদি বহুজাতিক যুগোস্লাভিয়া ও ফুটবলকে একাত্ম করার স্বপ্ন দেখে থাকেন তো সেই মানুষটি আইভিকা ওসিম; রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ভেঙে
যাওয়ার আগে যুগোস্লাভিয়া দলের কোচ ছিলেন যিনি। ইতালিতে ১৯৯০ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে টাইব্রেকারে হেরে বিদায় নিতে হয়েছিল তাঁর দলকে।

সার্বিয়ান সৈন্যরা যখন বসনিয়ায় বোমা হামলা করছিল, তখন কান্না চেপে সার্বিয়ার সাংবাদিকদের কাছে আকুতি জানিয়েছিলেন আইভিকা ওসিম, ‘তাদের কি একবারও মনে হয়নি, আমার বাড়িও সারায়েভোয়?’ ৭৭ বছর বয়সী সেই বসনিয়ার কোচের হৃদয়ে ক্রোয়েশিয়ার জন্য শুধুই ভালোবাসা, ‘ব্যক্তিগত নৈপুণ্যকে দলীয় শক্তিতে পরিণত করতে পেরেছে ওরা, যেটা আমাদের মধ্যে খুব বেশি দেখা যায় না।’

তবে ভাষা আর সংস্কৃতির মিল থাকলেও প্রতিবেশী সার্বিয়ার অনেকেরই সমর্থন নেই ক্রোয়েশিয়ার পেছনে। ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে এই অঞ্চল থেকে গলা ফাটাতে চাইছেন যাঁরা, তাঁদের অধিকাংশই সার্বিয়ান। ক্রোয়েশিয়ার ওপর সার্বিয়ানদের বিদ্বেষ যে কতটা, সেটি আবার প্রমাণ হয়েছিল রাশিয়া বিশ্বকাপ শুরুর আগেই। জুনের শুরুতে সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে ফুটবল স্কুলের শিশুদের নিয়ে আয়াজন করা হয়েছিল ৩২ দলের ‘মিনি বিশ্বকাপ’। বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী ৩১ দলের জার্সি পরে নেমেছিল কচিকাঁচার দল। শুধু একটিই ব্যতিক্রম! সার্বিয়ানদের অনুভূতিতে যেন আঘাত না দেয়, সে কারণে ক্রোয়েশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করা দলটিকে পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল সাদা-কালো টি-শার্ট!

শুধু কি তা–ই! ক্রোয়েশিয়াকে সমর্থন দিয়ে বিপাকে পড়েছেন সার্বিয়ার সবচেয়ে বড় ক্রীড়া তারকা নোভাক জকোভিচ। সার্বিয়ার ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দলের নেতা ভ্লাদিমির দুকানোভিচ টুইট করে জকোভিচকে রীতিমতো ধুয়ে দিয়েছেন, ‘একমাত্র গর্দভরাই ক্রোয়েশিয়াকে সমর্থন করতে পারে! তোমার লজ্জা করে না, নোভাক?’

এমনই আরেক ক্রোয়াটবিদ্বেষী খোদ সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দর ভুচিচ। কোনো লুকোছাপা নেই। বরং বলছেন, ‘আমি রাশিয়াকে সমর্থন করেছিলাম, এটা আমার অধিকার। সার্বিয়া গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং সবারই নিজের পছন্দের দলকে সমর্থন দেওয়ার অধিকার আছে।’

পুরো ক্রোয়েশিয়া ভাসছে আনন্দে। ছবি: রয়টার্স
পুরো ক্রোয়েশিয়া ভাসছে আনন্দে। ছবি: রয়টার্স

অনেক সার্বিয়ান অবশ্য হৃদয়নিংড়ানো ভালোবাসায় ভেজাচ্ছেন মদরিচদের। কেউ আবার দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের ওয়েবসাইটে লিখেছেন, ‘আমাদের খেলোয়াড় আর ফেডারেশনের উচিত ক্রোয়াটদের কাছ থেকে ফুটবলের পাঠ নেওয়া!’

যুগোস্লাভিয়া ভেঙে জন্ম হওয়া মেসিডোনিয়ার অধিকাংশ বাসিন্দা ক্রোয়েশিয়ার সমর্থক। দেশটির প্রধানমন্ত্রী জোরান জায়েভের টুইট, ‘অভিনন্দন ক্রোয়েশিয়া। রাজনীতি, খেলা, আঞ্চলিক রাজনীতি এবং বিশ্ব আজ একসঙ্গে এসে দাঁড়িয়েছে।’ ছয় হাজার ক্রোয়াট এখনো থাকেন সার্বিয়া ভেঙে জন্ম নেওয়া মন্টেনেগ্রোয়। দেশটির এক নাগরিক ভিয়েস্তি সংবাদপত্রের ওয়েবসাইটে লিখেছেন, ‘রাজনীতি সরিয়ে রাখুন। পড়শি তোমাদের টুপি খোলা অভিনন্দন! তোমরা সাবেক যুগোস্লাভিয়ার গর্ব।’

এখনো বহু ক্রোয়াটের আবাস বসনিয়ায়। সেই বসনিয়ার সমর্থনও পাচ্ছে বিশ্বকাপের ফাইনালিস্টরা। জোরান ক্রেসিচ নামের এক বসনিয়ান রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, ‘এই সমর্থনের বিষয়টি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এই প্রথম এই অঞ্চল ও বসনিয়াকে এক সুতোয় গেঁথেছে।’

ভেঙে যাওয়া যুগোস্লাভিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের উষ্ণতা বাড়ছে হয়তো এভাবেই!