এটাই কি সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ?

জমকালো বিশ্বকাপের জাঁকালো সমাপন! কাল মস্কোতে। ছবি: রয়টার্স
জমকালো বিশ্বকাপের জাঁকালো সমাপন! কাল মস্কোতে। ছবি: রয়টার্স
সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ কি না, এ নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। তবে এই বিশ্বকাপটা অবশ্যই অন্য রকম


উত্তরটা অনেকের কাছ থেকেই শুনতে পারেন। তবে কখনো ফিফা সভাপতির কাছ থেকে শুনতে যাবেন না। আয়োজক হিসেবে যেকোনো আয়োজনকে সফল বলার একটি দায়বদ্ধতা থাকে। সেই দায়বদ্ধতা মেনে প্রতিটি বিশ্বকাপের শেষের দিকে ফিফা সভাপতি বলে দেন, আমরা সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপটা দেখলাম এবার। অথবা এ রকমই কিছু একটা। এবারও যেমন সেই ধারাবাহিকতা রেখে জিয়ান্নি ইনফান্তিনো বলে দিয়েছেন, রাশিয়া বিশ্বকাপই সর্বকালের সেরা। 

আসলেই কি সেরা? কিংবা যদি সেরা না-ও হয়, ইতিহাস কীভাবে মনে রাখবে রাশিয়া বিশ্বকাপকে?

যেকোনো বিশ্বকাপকে সেরা হতে হলে সবার আগে দারুণ সব ম্যাচ উপহার দেওয়ার শর্তটা পূরণ করতে হয়। সেটা অবশ্য রাশিয়া বিশ্বকাপ ভালোভাবেই পেরেছে। দুর্দান্ত কিছু ম্যাচ হয়েছে, দুর্দান্ত কিছু গোলও। গোলের সংখ্যাটাও একেবারে কম নয়। এর আগে সবচেয়ে গোলপ্রসবা দুটি বিশ্বকাপ ছিল ১৯৯৮ ও ২০১৪। দুটিতেই হয়েছে ১৭১টি করে গোল। রাশিয়া বিশ্বকাপ দেখেছে ১৬৯টি গোল। এত গোল হয়েছে, কিন্তু গোলকিপারদের বিশ্বকাপটা খারাপ কেটেছে বলা যাবে না। ব্রাজিল বিশ্বকাপটা যদি নয়্যার-নাভাস-হাওয়ার্ড-ওচোয়াদের হয়ে থাকে, এই বিশ্বকাপটা থিবো কোর্তোয়া-দানিয়েল সুবাসিচ-হুগো লরিস-কাসপার স্মাইকেলদের।

কিন্তু এটুকু দিয়ে কি আর একটা বিশ্বকাপ অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা হয়ে যেতে পারে! রাশিয়া বিশ্বকাপ অবশ্য একটা জায়গায় অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা। বড় দল আর ছোট দলের ব্যবধান যেন একলাফে অনেকটাই কমে গেছে এই বিশ্বকাপে। শুরুতে দেখে অবশ্য মনে হয়েছিল, এ রকম একটি-দুটি অঘটন তো ঘটতেই পারে। কিন্তু বিশ্বকাপ যত গড়িয়েছে, ততই বোঝা গেছে, এগুলো স্রেফ অঘটন নয়। আগে যেমন পরাশক্তিদের তুলনামূলক ছোট দলের বিপক্ষে নামার আগে জয় নিয়ে খুব একটা দুশ্চিন্তা করতে হতো না, সেটা ভুল প্রমাণ করেছে রাশিয়া বিশ্বকাপ।

দক্ষিণ কোরিয়ার জার্মানিকে হারানোটাকে যদি অঘটন বলেনও, মেক্সিকো কিন্তু দারুণ খেলেই হারিয়েছে গতবারের চ্যাম্পিয়নদের। আর্জেন্টিনার আইসল্যান্ডের সঙ্গে ড্র করা, ক্রোয়েশিয়ার কাছে হারা, ওদিকে জাপানের কলম্বিয়াকে হারানো, বেলজিয়ামের সঙ্গে দুই গোলে এগিয়ে যাওয়া, ইরানের পর্তুগালের সঙ্গে ড্র করা, স্পেনের সঙ্গে মরক্কোর ড্র! এই ম্যাচগুলো বুঝিয়ে দিয়েছে, বড় দল হলেই জয় ধরে নিয়ে মাঠে নামার দিন শেষ। নইলে বিশ্বকাপের আগে কে ভেবেছিল ক্রোয়েশিয়া ফাইনালে উঠবে, সুইডেন খেলবে কোয়ার্টার ফাইনালে!

শেষ মুহূর্তের নাটকীয়তাও এই বিশ্বকাপটা আলাদা করে রাখবে আগেরগুলোর চেয়ে। শেষ মুহূর্তের গোল তো যেন নিয়মই হয়ে গেছে এই বিশ্বকাপের। এবার ১৯টি গোল হয়েছে যোগ হওয়া সময়ে। শেষ ৫ মিনিটে হয়েছে ২৯টি গোল। ১৭টি ম্যাচের ফল বদলে গেছে শেষ ৫ মিনিটের এই নাটকীয়তা! সবচেয়ে বড় উদাহরণ তো সুইডেনের বিপক্ষে শেষ বাঁশি বাজার মুহূর্তকাল আগে টনি ক্রুসের সেই ফ্রি-কিক থেকে গোল।

গোলে ছন্দে নাচিয়ে গেছে এবারের বিশ্বকাপ। ছবি: রয়টার্স
গোলে ছন্দে নাচিয়ে গেছে এবারের বিশ্বকাপ। ছবি: রয়টার্স

ফুটবল আকাশের বড় তারারা বিশ্বকাপে জ্বলে উঠবেন-বিশ্বজোড়া ফুটবল-ভক্তদের এটাই থাকে প্রত্যাশা। এই জায়গায় রাশিয়া বিশ্বকাপ অবশ্য কিছুটা হতাশ করেছে। লিওনেল মেসি, নেইমার, টমাস মুলাররা আহামরি কিছু করতে পারেননি। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর শুরুটা দুর্দান্ত হলেও শেষটা খুব একটা ভালো হয়নি। তবে নতুন তারা উপহার দেওয়ার ধারাটা টিকে থাকল এই বিশ্বকাপেও। ব্রাজিল বিশ্বকাপ যেমন হামেস রদ্রিগেজকে নতুন করে চিনিয়েছিল ফুটবল বিশ্বের কাছে—এই বিশ্বকাপ চেনাল কিলিয়ান এমবাপ্পেকে।

আর ভিএআরের কথা তো না বললেই নয়। এই প্রযুক্তির সঙ্গে বিশ্বকাপ কতটা খাপ খাওয়াতে পারবে, সেই সন্দেহ ছিল টুর্নামেন্ট শুরুর একেবারে আগমুহূর্তেও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে রাশিয়া বিশ্বকাপে ভিএআর খুব সফলভাবেই ব্যবহৃত হয়েছে। মানবীয় ভুল যে অনেক কমে এসেছে, এটা স্বীকার করবেন সম্ভবত সবাই।
সেরা হোক বা না হোক, নতুন প্রযুক্তি দিয়ে বিশ্বকাপকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দেওয়ার জন্য হলেও রাশিয়ার এই টুর্নামেন্টকে আলাদা করে মনে রাখবে সবাই।