বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার অনেক লাভ

>
মানুষ আর মানুষ। পতাকা আর পতাকা। পরশু জাগরেবে। ছবি: রয়টার্স
মানুষ আর মানুষ। পতাকা আর পতাকা। পরশু জাগরেবে। ছবি: রয়টার্স
বিশ্বকাপে সাফল্য শুধু ক্রোয়েশিয়ার ফুটবল নয়, অর্থনীতিতেও বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।

জাগরেব বিমানবন্দর থেকে শহরের জেলাচিচ স্কয়ারে যেতে সাধারণত সময় লাগে আধা ঘণ্টার মতো। ছাদখোলা বাসে সেই পথটা পাড়ি দিতে লুকা মদরিচদের লেগে গেল পাক্কা ছয় ঘণ্টা! আর লাগবে না-ই বা কেন! পুরো দেশের মানুষ যেন নেমে এসেছিল রাস্তায়। তাদের অভিনন্দন, ভালোবাসার কনফেত্তি বর্ষণে সিক্ত হতে হতে এগিয়েছেন মদরিচ-রাকিতিচরা। ক্রোয়েশিয়ার সংবাদমাধ্যম বলছে, অন্তত সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ পরশু রাস্তায় নেমেছিল বিশ্বকাপ থেকে রানার্সআপ হয়ে ফেরা দেশের ফুটবল দলকে বরণ করতে। যেটি দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ ভাগের মতো। ক্রোয়েশিয়া স্বাধীন হওয়ার পর এর চেয়ে বেশি জনসমাগম হয়েছে মাত্র একবারই, ১৯৯৪ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পলের সফরের সময়।

বিমানবন্দরেই ক্রোয়াট খেলোয়াড়দের লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়ার পর খেলোয়াড়দের সঙ্গে বাসের ছাদে চড়ে বসেছেন দেশটির জনপ্রিয় গায়ক মার্কো পারকোভিচ। জনসমুদ্র ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার পুরো সময়টা তিনি নাচে-গানে মাতিয়ে রেখেছেন। তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন ক্রোয়াট সমর্থকেরাও। ‘ভাতরেনি’ (আগুন) ‘ভাতরেনি’ গর্জন তুলেছেন তাঁরা। ক্রোয়াট ফুটবল দলটাকে ভালোবেসে ওই নামেই ডাকেন দেশটির ফুটবলপ্রেমীরা।

ভালোবাসায় আপ্লুত মদরিচ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘ধন্যবাদ ক্রোয়েশিয়া, ধন্যবাদ জাগরেব।’ আর সঙ্গে সঙ্গেই ‘চ্যাম্পিয়ন’ ‘চ্যাম্পিয়ন’ গর্জন উঠেছে। বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও ক্রোয়াটদের হৃদয়ের চ্যাম্পিয়ন তো মদরিচরাই। দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলোতেও একই সুর। ক্রোয়াট দৈনিক ইয়ুতারনি লিস্ত লিখেছে, ওরা ফাইনাল হেরেছে, কিন্তু জয় করে এসেছে বিশ্ব।

কথাটা তো ঠিকই। এই বিশ্বকাপ দিয়েই তো ক্রোয়েশিয়াকে নতুন করে চিনল বিশ্ব। যুগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৯৮ সালে প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েই সেমিফাইনালে উঠে সবাইকে চমকে দিয়েছিল সুকার-বোবানদের সোনালি প্রজন্ম। কিন্তু এবার মদরিচ-রাকিতিচরা শুধু সেই সাফল্যই ছাড়িয়ে যাননি, যেন হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের কাছে ক্রোয়েশিয়ার দূত। তাঁদের হার না মানা মানসিকতা, চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা মুগ্ধ করেছে সবাইকে। এই ভাবমূর্তি শুধু ক্রোয়েশিয়ার ফুটবল নয়, অর্থনীতিতেও বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।

দুর্নীতি, অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে ক্রোয়েশিয়ার অর্থনীতি বেশ কয়েক বছর ধরেই একটু নড়বড়ে। এক পরিসংখ্যান বলছে, শুধু ২০১৭ সালেই ৪০ হাজার লোক দেশ ছেড়েছেন উন্নত জীবনের আশায়। এই অবস্থায় বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সের কারণে ক্রোয়েশিয়াকে যে বিশ্ব নতুন করে চিনল, সেটা ক্রোয়াট অর্থনীতিতে নতুন করে প্রাণ এনে দেবে বলে মনে করছেন গবেষকেরা। জাগরেব বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বোজো সকো যেমন বলছেন, ‘ক্রোয়াট ফুটবল দলের এই পারফরম্যান্স দেশের ভাবমূর্তি আমূল বলতে দিতে পারে। সংবাদমাধ্যমের মাতামাতি, দলটার জনপ্রিয়তা আমাদের দেশের পর্যটন খাতে প্রভাব ফেলবে। যার একটা ছাপ আমাদের অর্থনীতিতেও পড়বে।’

এই ভাবমূর্তি গড়ার পেছনে অবশ্য খেলোয়াড়দের পাশাপাশি আরও একজন বড় ভূমিকা রেখেছেন। ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট কলিন্দা গ্রাবার-কিতারোভিচ। নিজের খরচে বিমানের ইকোনমি ক্লাসে করে রাশিয়ায় গেছেন, দলের জার্সি গায়ে সারাক্ষণ ভিভিআইপি গ্যালারিতে মাতামাতি করেছেন। ন্যাটো সম্মেলন থাকায় শুধু ক্রোয়েশিয়ার সেমিফাইনালটা দেখতে পারেননি। কিন্তু ফাইনালসহ অন্য সব ম্যাচে দেশের ফুটবল দলটাকে ঘিরে তাঁর আবেগ ছুঁয়ে গেছে সবাইকে। ফাইনাল শেষে বৃষ্টিতে ভিজে অভিনন্দন জানিয়েছেন দুই দলের খেলোয়াড়দের। মিডিয়াটুলকিট নামে জাগরেবভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, ক্রোয়েশিয়া দলের খেলোয়াড়দের চেয়েও অনেক সময় তাঁকে নিয়ে বেশি খবর করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। এর শতকরা ৮০ ভাগই ছিল ইতিবাচক।

সব মিলিয়ে ক্রোয়েশিয়ার এবারের বিশ্বকাপ অভিযানটাকে দারুণ সফল মনে করছেন দেশটির ফুটবলবোদ্ধা থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবীরা। বলকান রাজনীতির বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক লইচ ত্রেগোরেস যেমন বলছেন, ‘এটা ক্রোয়েশিয়ার জন্য দুর্দান্ত এক প্রচারণা ছিল। ১৯৯৮ বিশ্বকাপের চেয়েও সফল ও কার্যকর।’
সেটির ছাপ এখন অর্থনীতিতেও পড়লে এই বিশ্বকাপ অমর হয়ে যাবে ক্রোয়েশিয়ার ইতিহাসে।