এশিয়া কাপের প্রথম দিনেই ঝাঁজালো এক ম্যাচ

নিদাহাস ট্রফির পর এই প্রথম শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি বাংলাদেশ। ছবি: টুইটার
নিদাহাস ট্রফির পর এই প্রথম শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি বাংলাদেশ। ছবি: টুইটার

ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো তুলনা চলে না, সেটি অনেক বড় এবং তাতে খেলার বাইরেও আরও অনেক কিছু জড়িয়ে। শুধু খেলার সীমাতে আবদ্ধ থেকেই এশিয়ান ক্রিকেটে ঝাঁজালো প্রতিদ্বন্দ্বিতার আরেকটি গল্প কিন্তু ক্রমশ দানা বাঁধছে। সাম্প্রতিক অতীতের দিকে একটু ফিরে তাকালেই যেটির ঝাঁজ এসে নাকে লাগে। ঘটনাচক্রে আজ সংযুক্ত আরব আমিরাতে এশিয়া কাপের ১৪তম আসরের পর্দাও উঠছে ক্রিকেটের সেই নবতম দ্বৈরথ দিয়েই। বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা!

ঝাঁজালো যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলা হলো, তা খুব একটা পুরোনো নয়। সুনির্দিষ্টভাবে বললে এই ২০১৮ সালেই এটির জন্ম। সূচনা অবশ্যই বাংলাদেশ দলের কোচের দায়িত্ব ছেড়ে চন্ডিকা হাথুরুসিংহের নিজের দেশে চলে যাওয়া। পেশাদার দুনিয়ায় কোচরা আকছার এমন করেন। তবে হাথুরুসিংহের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন ছিল। যেভাবে গিয়েছিলেন, বিতর্কের সব উপাদানই মজুদ ছিল তাতে। একটা সফরের মাঝপথে কোনো কোচ ই-মেইলে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলে তাঁকে কি আর হাসিমুখে বিদায় দেওয়া যায়! সেই তিক্ততা হয়তো সময়ের প্রবাহে চাপা পড়ে যেত। কিন্তু ঘটনাচক্রে শ্রীলঙ্কার কোচ হিসেবে হাথুরুর প্রথম সিরিজই বাংলাদেশে এবং বাকি সব ছাপিয়ে টেকো মাথার শ্রীলঙ্কানই হয়ে উঠলেন সেটির মূল চরিত্র।

এর কিছুদিন পর শ্রীলঙ্কায় নিদাহাস ট্রফিতে আরও দাউ দাউ করে জ্বলল প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগুন। মাঠে দুই দলের খেলোয়াড়দের লেগে যাওয়া, রাগে গরগর করতে করতে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মাঠ থেকে বেরিয়ে আসার ইশারা, জয়ের পর মাঠে বাংলাদেশের খেলোয়াড়-কর্মকর্তাদের উন্মাতাল ‘নাগিন-নাচ’-গত মার্চে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচ ব্যতিক্রমী সব ছবির কোলাজ। সেই প্রেক্ষাপটেই আজ আবার মুখোমুখি দুই দল। মাঠে ব্যাট-বলের লড়াইয়ে কেউ তাই গোলাবারুদের শব্দ শুনতেই পারেন!

যে দুই দেশ মুখোমুখি হলে এই ‘গোলাবারুদ’ কথাটা বেশি প্রাসঙ্গিক হয়, মরুর দেশের মহাকাঙ্ক্ষিত ভারত-পাকিস্তান মহারণও আছে এখানে। রাজনৈতিক বৈরিতার কারণে বেশ কিছুদিন ধরে বিশ্বকাপ আর চ্যাম্পিয়নস ট্রফির বাইরে শুধু এশিয়া কাপেই দেখা হয় দুই দলের। আয়োজকদের আশা পূরণ করে দুই দল ফাইনালে উঠলে দশ দিনের মধ্যে তিন-তিনটি ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ দেখে ফেলবে এই এশিয়া কাপ। ঘটনাচক্রে এমন হয়ে গেছে মনে করে থাকলে বুঝতে হবে আপনি খুবই সরল মনের মানুষ। আসলে ভেবেচিন্তেই টুর্নামেন্টের ফরম্যাটটা এমন করা হয়েছে। নইলে সংযুক্ত আরব আমিরাত এই টুর্নামেন্টের আয়োজক হতে রাজি হতো বলে মনে হয় না।

কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের ক্লাসে দুই লঙ্কান পেসার দাসুন শানাকা ও লাসিথ মালিঙ্গা। ছবি: এএফপি
কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের ক্লাসে দুই লঙ্কান পেসার দাসুন শানাকা ও লাসিথ মালিঙ্গা। ছবি: এএফপি

এই এশিয়া কাপটা হওয়ার কথা ছিল ভারতে। কিন্তু সেটি হলে পাকিস্তানের অংশ নেওয়া নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা থাকত। এ কারণেই মরুর দেশের নিরপেক্ষ ভেন্যুর শরণাপন্ন হওয়া। এর আগেও এশিয়া কাপ এই জটিলতায় পড়েছে। একবার শ্রীলঙ্কায় খেলতে যায়নি ভারত, আরেকবার ভারতে যায়নি পাকিস্তান। মাঝখানে এশিয়া কাপ যে বলতে গেলে জাতীয় লিগ, প্রিমিয়ার লিগ-এর মতো বাংলাদেশের আরেকটি ‘ঘরোয়া টুর্নামেন্ট’ হয়ে গিয়েছিল, এটিতেও বড় ভূমিকা এ-জাতীয় জটিলতার। ২০১২, ২০১৪, ২০১৬-টানা তিনটি এশিয়া কাপের আয়োজক বাংলাদেশ। তিনটির মধ্যে দুটিরই ফাইনাল খেলেছে বাংলাদেশ। একটু হলেও স্বাগতিক হওয়ার ভূমিকা তো ছিলই। এতে আরেকটা কাজও হয়েছে। মাশরাফি-সাকিবদের জন্য দেশের বাইরে এশিয়া কাপ খেলাটা পরিণত হয়েছে প্রায় ভুলে যাওয়া এক অভিজ্ঞতায়।

টুর্নামেন্টটা ভারতে না হওয়াতে একটা কাজের কাজ অবশ্য হয়েছে। এশিয়া কাপ ফিরেছে তার উৎসমুখে। ৩৪ বছর আগে এই সংযুক্ত আরব আমিরাতেই শুরু এশীয় শ্রেষ্ঠত্বের এই লড়াইয়ের। এরপর আরও একবার, ১৯৯৫ সালে এশিয়া কাপ আয়োজিত হয়েছে আমিরাতে। দুবারই শারজায়। গত শতাব্দীর শেষ দুই দশকে পাকিস্তান-ভারত দ্বৈরথকে পুঁজি করে এই শারজাতেই পাখা মেলেছিল ওয়ানডে ক্রিকেট। বছরে জমজমাট দুটি টুর্নামেন্ট হতো সেখানে। এবার অবশ্য শারজায় কোনো খেলাই নেই। দুবাই ও আবুধাবির ঝা-চকচকে দুটি স্টেডিয়াম বহুদিনই এই দেশে ক্রিকেট ভেন্যু হিসেবে তৃতীয় পছন্দ বানিয়ে দিয়েছে শারজাকে।

২৮ সেপ্টেম্বর ফাইনাল দুবাইয়ে, আজ বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা উদ্বোধনী ম্যাচও। সাধারণ একটা গ্রুপ ম্যাচ, কিন্তু গুরুত্বের দিক দিয়ে মোটেই সাধারণ কোনো ম্যাচ নয়। ছয় দলের টুর্নামেন্টে এক গ্রুপে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে হংকং। ‘এ’ গ্রুপ থেকে ভারত ও পাকিস্তান পরের রাউন্ডে উঠে গেছে বলে তাই ধরেই নেওয়া যায়। ‘বি’ গ্রুপের সমীকরণটা এত সরল নয়। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে এখানে আফগানিস্তান। ওয়ানডে-টি টোয়েন্টিতে অনেক দিনই সমীহ-জাগানো দল, তার ওপর টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে প্রথম এশিয়া কাপ। এমনিতেই আফগানরা কখনো উদ্দীপনার অভাবে ভুগেছে বলে শোনা যায়নি, এবার তো তারা আরও বেশি উদ্দীপ্ত। তাদের মুখোমুখি হওয়ার আগে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা দুই দলই তাই সঞ্চয়ে রাখতে চাইবে একটি জয়।

সাম্প্রতিক ইতিহাসের সঙ্গে এটি যোগ করুন। ‘গোলাবারুদ’ কথাটাকে আর বাড়াবাড়ি মনে হবে না!