ডানেডিনের সেই ইনিংসটি মনে আছে, মুশফিক?

>২০১০ সালের নিউজিল্যান্ড সফরে এই ডানেডিনেই ব্যাটিং বিপর্যয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে দারুণ এক ইনিংস খেলেছিলেন মুশফিকুর রহিম। কাল একই মাঠে সিরিজের শেষ ম্যাচে সে ইনিংসটিকে প্রেরণা বানাতেই পারেন তিনি।

গ্লাভস-প্যাড-হেলমেটে সজ্জিত হয়ে ড্রেসিংরুমেই কিছুক্ষণ শ্যাডো ব্যাটিং করলেন। তারপর গেলেন মাঠের পেছনের নেটে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সেখানে সবচেয়ে বেশি সময় কাটালেন তিনিই। পাঁজরের যে পাশটায় অস্বস্তি বোধ করছিলেন, সকালে সেটির এমআরআই করিয়ে এসেছেন। রিপোর্ট পাওয়া গেছে বিকেলে। তবে আজ দুপুরে নেটে মুশফিকের ব্যাটিং দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, সেই রিপোর্টে কী থাকবে।

উইকেটে স্বচ্ছন্দ চলাফেরাই কিছুটা বুঝিয়ে দিচ্ছিল। সামনের পা পুরোটা বাড়িয়ে ডিফেন্স করা আরেকটু। সবচেয়ে বেশি বুঝিয়ে দিল স্বচ্ছন্দে পুল খেলা। চোটটা গুরুতর কিছু হলে যা খেলতে পারারই কথা নয়। নেটে দু–একবার চিৎকার করে উঠলেন মুশফিক। তবে সেটি যন্ত্রণায় নয়; যে শটটা খেলতে চেয়েছিলেন, সেটি খেলতে পারেননি বা খেললেও মনমতো হয়নি বলে।
দুপুরে নেটের মুশফিককে দেখে যা মনে হয়েছিল, বিকেলে পাওয়া রিপোর্টি তা কেবল নিশ্চিতই করল। মুশফিকের বড় কোনো সমস্যা নেই। আগামীকাল ওয়ানডে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে তো তাহলে খেলছেনই। টিম ম্যানেজমেন্ট অবশ্য একটু ফাঁক রেখে দিচ্ছে। কাল সকালে মুশফিক কেমন বোধ করেন, কী বলেন—সেটির ভিত্তিতেই নাকি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। যেটিকে ইচ্ছাকৃত একটা ধোঁয়াশা তৈরির চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না।
মুশফিক যখন নেটে ব্যাটিং করছেন, তার কিছুক্ষণ আগে মোহাম্মদ মিঠুন ধীরপায়ে চক্কর দিচ্ছেন মাঠে। ডান পা–টা একটু টেনে টেনে হাঁটছেন। তাঁর হ্যামস্ট্রিংয়ে যে ভালোই লেগেছে, সেটি বুঝতে আসলে স্ক্যানের প্রয়োজন ছিল না। স্ক্যান করতে হয়েছে চোট কতটা গুরুতর, সেটি জানতে। স্ক্যানের রিপোর্টে যা জানা গেল, তাতে ১২ থেকে ১৪ দিন মাঠের বাইরে থাকতে হবে মিঠুনকে। চোটটা পেয়েছিলেন ১৬ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় ওয়ানডেতে। ১২ থেকে ১৪ দিনের হিসাবটা হবে সেদিন থেকে। ১২ দিনে সেরে গেলে সুস্থ মিঠুনকে পেতে পেতে ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৪ দিন লাগলে ২ মার্চ। ২৮ ফেব্রুয়ারি হ্যামিল্টনে শুরু প্রথম টেস্টের আগে ফিট হয়ে ওঠাটা তাই একটু কঠিনই হবে।

ডানেডিনে ২০১০ সালে খেলা সেই ইনিংসটি প্রেরণা বানাতে পারেন মুশফিকুর রহিম। ছবি: এএফপি
ডানেডিনে ২০১০ সালে খেলা সেই ইনিংসটি প্রেরণা বানাতে পারেন মুশফিকুর রহিম। ছবি: এএফপি

টেস্ট তো পরের কথা, আপাতত এর চেয়েও জরুরি প্রশ্ন হলো—কাল শেষ ওয়ানডেতে মিঠুনের বদলে কে আসছেন দলে? মিঠুনের পর মুশফিককে নিয়ে সংশয়ের কারণে আজ সকালে ক্রাইস্টচার্চ থেকে উড়িয়ে আনা হয়েছে মুমিনুল হককে। দুজনই খেলতে না পারলে যাঁর খেলাটা নিশ্চিতই ছিল। মুশফিক খেলছেন ধরে নিলেও ‘অ্যাপল ফর অ্যাপল’ নির্বাচনের নীতি অনুসরণ করলে তা-ই থাকার কথা। কিন্তু সেটি সম্ভবত করা হচ্ছে না। সিরিজ পরাজয় যেহেতু নিশ্চিতই হয়ে গেছে, হারানোর আর তো কিছু নেই। মাশরাফি বিন মুর্তজা তাই দলে আরেকজন বোলার বাড়িয়ে ইতিবাচক বার্তাই ছড়িয়ে দিতে চাইছেন। বিপিএলে দারুণ বোলিং করে এসেও রুবেল হোসেনের বাইরে থাকাটা এমনিতেই অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। মাশরাফি আর মোস্তাফিজ তো অটোমেটিক চয়েস। বিশ্বকাপে একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার লাগবে বলে রুবেলের বদলে সাইফউদ্দিনকে খেলিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রুবেলের একাদশ থেকে বাদ পড়তে অবশ্য কারণের অভাব হয় না। কখনো টিম কম্বিনেশন, কখনো বা অন্য কোনো যুক্তিতে ভালো ফর্মে থেকেও অতীতে অনেকবারই বাদ পড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর। এমন হতে হতে ব্যাপারটা বোধ হয় তাঁর সয়েও গেছে। তাঁর মুখ দেখে তাই মনের ভাব বোঝার উপায় নেই। কাল সুযোগ পেলে তাঁর প্রতি ‘অবিচার’-এর জবাব দেওয়ার একটা সুযোগও তাই পাবেন রুবেল।
এই মাঠে এর আগে বাংলাদেশ যে একটি ওয়ানডে খেলেছে, তাতে ২ উইকেট নিয়েছিলেন রুবেল। পিটার ইনগ্রামের পর আউট করেছিলেন এই সিরিজের বাংলাদেশের বোলারদের দুঃস্বপ্ন হিসাবে আবির্ভূত মার্টিন গাপটিলকে। রান অবশ্য অনেক দিয়েছিলেন—৯.৩ ওভারে ৬৮। মাত্র ১৮৩ রানের পুঁজি নিয়ে বোলিং করলে অবশ্য মার খাওয়াটাই বোলারদের কপালের লেখন। সেটি কম-বেশি বাংলাদেশের সব বোলারই খেয়েছিলেন সেদিন।
২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির ওই ম্যাচটা কি আপনার মনে আছে, মুশফিক? গত দুদিন এত কথা হলো, অথচ এটা জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছি। তবে অনুমানেই বলে দিতে পারি, মুশফিকুর রহিমের সেটি ভোলার কথা নয়। সেঞ্চুরি হয়নি বলে তেমন আলোচিত নয়। কিন্তু মুশফিকের ১০৭ বলে ৮৬ রানের ওই ইনিংসটি তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা বলে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবিদার। নেমেছিলেন ২৩ রানে ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর। কিছুক্ষণের মধ্যেই ৫ উইকেটে ২৫। এর কিছুক্ষণ পর ৬ উইকেটে ৪৬। এই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে কী ব্যাটিংটাই না করেছিলেন মুশফিক! ৮টি চার ও ৩টি ছয় খচিত ইনিংসটি শেষ হয়েছিল বাংলাদেশের ইনিংসের তিন বল বাকি থাকতে। সেটি ছিল ডানেডিনের ইউনিভার্সিটি ওভাল মাঠের ওয়ানডে অভিষেক। ম্যাচের সেরা ইনিংসটি খেলেও মুশফিক ম্যাচ-সেরার স্বীকৃতি পাননি শুধু একটা কারণেই—এই বিশ্ব পরাজিতদের মনে রাখে না। ৫২ বলে ৭৮ রানের এক ইনিংস খেলে যেটি মুশফিকের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন রস টেলর।
সেই একই মাঠে সেই টেলরকে কাল হাতছানি নিয়ে ডাকবে একটা রেকর্ড। ৫১ রান করলেই স্টিভেন ফ্লেমিংকে ছাড়িয়ে ওয়ানডেতে নিউজিল্যান্ডের পক্ষে সবচেয়ে বেশি রানের মালিক হয়ে যাবেন তিনি। রস টেলরের বড় একটা কিছু পাওয়ার আছে। নিউজিল্যান্ডের আছে বাংলাদেশকে হোয়াইটওয়াশ করার প্রেরণা। বাংলাদেশের কী পাওয়ার আছে এই ম্যাচ থেকে?
আপাতদৃষ্টিতে কিছুই না। প্রথম দুই ম্যাচ হেরে সিরিজ তো শেষই। তারপরও মাশরাফি মনেপ্রাণে চাইছেন ম্যাচটা জিততে। সেটি তো সব ম্যাচেই চান। এখানে একটু বাড়তি চাওয়ার কারণ আগামী বিশ্বকাপ। গত বছর আয়ারল্যান্ডে নিউজিল্যান্ডকে হারানোর কথা মনে করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আয়ারল্যান্ডেও কিন্তু সেই ম্যাচ থেকে আমাদের কিছু পাওয়ার ছিল না। জিতলেও আমাদের ফাইনাল খেলার সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু সেই ম্যাচটা আমরা জিতেছিলাম। পরে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেও নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছি।’
এখানেও ঘটনা একই। সিরিজ হয়তো শেষ, কিন্তু আপাত অর্থহীন এই ম্যাচে জয় বড় প্রেরণা হবে বিশ্বকাপের জন্য। প্রথম দুই ম্যাচে যে পারফরম্যান্স, তাতে অবশ্য জয়ের আশা করতে ভয়ই হয়! অবস্থাটা এমনই যে, মনে হচ্ছে, ম্যাচে একটু প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার চাওয়াটা পূরণ হলে সেটিই বা কম কী!