ফুটবলের ফার্গিরা

লুইস ফেলিপে স্কলারি: ব্রাজিলের ভরসা, স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন: বিদায় ফুটবল, পেপ গার্দিওলা: বায়ার্নে নতুন অভিযান
লুইস ফেলিপে স্কলারি: ব্রাজিলের ভরসা, স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন: বিদায় ফুটবল, পেপ গার্দিওলা: বায়ার্নে নতুন অভিযান

মে মাসের মাঝামাঝি থেকে মধ্য আগস্ট। ইউরোপীয় ফুটবলের দুটি মৌসুমের মাঝখানের এই তিন মাস বিরতি আমাদের কাছে যেন এক নিরন্নের কাল। একটু রাত বাড়লেই তৃষিত চোখগুলো টেলিভিশনে আঁতিপাঁতি করে কিছু খোঁজে। একটা সবুজ আয়তক্ষেত্রে পায়ে পায়ে ওঠা ঝড় নেই। গ্যালারিতে নেই রং আর সাগর-গর্জন। ডাগ-আউটে চিন্তাক্লিষ্ট কিংবা উচ্ছ্বসিত কোচ নেই। মেসি-রোনালদো-ফন পার্সি বা সুয়ারেজের অসাধারণ একেকটা গোলের স্মৃতি ঝাপসা। কবেকার উজ্জয়নী তীরে হারিয়ে ফেলা যেন জীবনের সব রোমাঞ্চ। এই তো আর মাত্র কটা দিন। দর্শকের কাছে আবার ফিরছে ফুটবলের নবান্ন। ৯ আগস্ট, ঈদের আগের রাত বা ঈদের রাতেই শুরু হয়ে যাচ্ছে জার্মান লিগ, বুন্দেসলিগা। যেখানে নতুন যুগ শুরু করবেন পেপ গার্দিওলা। ১৭ আগস্ট একই দিনে মাঠে গড়াবে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ও স্প্যানিশ লা লিগা। বিশ্ব ফুটবলের সর্বাধিক জনপ্রিয় এই লিগ দুটি এবার অনেক ভাঙা-গড়া ও উত্থান-পতনের। ২৭ বছর পর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ডাগ-আউটে ১৫০০ ম্যাচ শেষে ১৪,৯৮০টি চুইংগাম চিবিয়ে বিদায় নিয়েছেন একটি মুখ—স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। ইংলিশ লিগই এবার ফিরে পাচ্ছে পুরোনো এক চরিত্র—হোসে মরিনহো। সান্তিয়াগো বার্নাব্যু থেকে একরাশ মাতাল হাওয়া নিয়ে মরিনহো আবার যখন বসতি গাড়ছেন স্টামফোর্ড ব্রিজে, রিয়াল মাদ্রিদে রাজ্যপাট শুরু করছেন কার্লো আনচেলত্তি। কিন্তু সেখানে আরেকটি পরিবর্তন দৃশ্যমান। রিয়ালের ডাগ-আউটে আসছেন জিনেদিন জিদান। প্রধান কোচ নন, সহকারী। কিন্তু সহকারী কোচের ভূমিকাতেই সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলারের অভিষেক দেখতে যেন তর সইছে না ফুটবল বিশ্বের।

মারুফুল হক: শেখ রাসেলের ত্রিমুকুটজয়ী কোচ, গোলাম সারোয়ার টিপু: বাংলাদেশে কোচিংয়ের এক পথিকৃত্, হোসে মরিনহো: আবার চেলসির ডাগআউটে
মারুফুল হক: শেখ রাসেলের ত্রিমুকুটজয়ী কোচ, গোলাম সারোয়ার টিপু: বাংলাদেশে কোচিংয়ের এক পথিকৃত্, হোসে মরিনহো: আবার চেলসির ডাগআউটে


এরই মধ্যে জার্সি-শর্টস পরে অনুশীলন মাঠে মহড়াও দিয়ে ফেলেছেন জিজু। লম্বা পায়ের অলস সৌন্দর্যে বল নিয়ে দেখিয়েছেন কিছু কারুকাজ। কাকাকে মাঠের এক পাশে ডেকে নিয়ে সেদিন কথা বললেন। সবকিছুই কোচিংয়ে তাঁর গভীর অভিনিবেশের ইঙ্গিত। অবসরের পর ২০০৮ সালে জিদান বলেছিলেন, বাকি জীবনটা কাটাতে চান ফুটবলের সঙ্গেই। সেই জীবনে খেলাটার নিখাদ শুভেচ্ছাদূত হয়ে থাকার সুযোগ ছিল। কিন্তু বিশ্বকাপজয়ী আর তিনবারের বিশ্বসেরাকে মাঠই টেনেছে নিরন্তর। তাই আগ্রহ দেখিয়েছেন কোচিংয়ে যুক্ত হওয়ার। মৌলিক প্রশিক্ষণ কোর্স করেছেন। হুড়োহুড়ি করে প্রধান কোচ হওয়ার ইচ্ছে তাঁর কখনোই ছিল না। ২০১১ সালে রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক এই গ্যালাকটিকোকে ডেকে নিলেন রিয়াল মাদ্রিদ সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। ব্যক্তিগত উপদেষ্টা হিসেবে। পরের বছর ভেবেছিলেন, সহকারী কোচের ভূমিকাটা পাবেন। পাননি মরিনহোর অনিচ্ছায়। এবার আনচেলত্তি রিয়াল কোচের তপ্ত চেয়ারটিতে বসার পরই ডাক পড়ল। এটাই তো জিজু চেয়েছিলেন।

মারিও জাগালো, ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, ইয়োহান ক্রুইফরা ব্যতিক্রম। তা ছাড়া জগদ্বিখ্যাত ফুটবলারদের ভালো কোচ হওয়ার উদাহরণ কই? ফেরেঙ্ক পুসকাস খেলোয়াড়ি প্রতিভার ছিটেফোঁটাও অনুবাদ করতে পারেননি কোচিংয়ে। কোচিং পেশাটা পছন্দই হয়নি পেলের। অনেক ডঙ্কা বাজিয়ে ডিয়েগো ম্যারাডোনা যদিও কোচিংয়ে এলেন, কী হাল হলো সে তো দেখাই গেল। অনেকেরই বিশ্বাস, ফুটবল-প্রতিভারা যেমন জন্মায়, তেমনি সফল কোচেরও ঘটে আবির্ভাব।

জিদান সবে কোচিং ধারাপাত পড়তে শুরু করলেন। কত দূর যাবেন তা বলবে সময়। একজন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন, হোসে মরিনহো, পেপ গার্দিওলা বা লুইস ফেলিপে স্কলারির মতো মাঠের পাশে উজ্জ্বল আলো ছড়াতে পারবেন ম্যারাডোনার পর বিশ্বের সবচেয়ে মুগ্ধতা জাগানিয়া এই ফুটবল-প্রতিভা?

ফার্গুসনের মধ্যে কী ছিল, যা দিয়ে প্রায় ২৭ বছর সাফল্যের মশাল জ্বেলে রাখলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে? মরিনহোর মধ্যে কী আছে, যার জন্য সাফল্যতৃষ্ণায় ইউরোপের সেরা সেরা ক্লাব পতঙ্গের মতো ছুটে যায় তাঁর দিকে? গার্দিওলার কী সেই অলৌকিক ক্ষমতা, যার বিনিময়ে চার বছরে বার্সেলোনাকে জেতান ১৪টা ট্রফি? স্কলারির কী অতীন্দ্রিয় শক্তি যে দল খাদের দিকে এগোতে থাকলে উজ্জ্বল উদ্ধারের আশায় ব্রাজিল তাঁরই শরণ নেয় বারবার?

কার্লো আনচেলত্তি ও জিনেদিন জিদান: জুটি গড়লেন রিয়াল মাদ্রিদে
কার্লো আনচেলত্তি ও জিনেদিন জিদান: জুটি গড়লেন রিয়াল মাদ্রিদে

আমরা যাঁরা শুধুই ফুটবলের রোমাঞ্চ অনুভব করি, তাঁদের চোখে ধরা পড়ে ডাগআউটে ধরাচূড়া পরা একজন ফার্গি, চুইংগাম চিবোতে থাকা একটি অবিচল মূর্তি। মাঠের পাশে মরিনহোর পাগুলে দৌড় কিংবা লাফিয়ে শূন্যে ভাসমান গার্দিওলার ঘুষি। ফুটবলবোদ্ধাদের চোখে ফুটবলের এই দ্রোণাচার্যরা আলাদা বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। মারুফুল হক গত মৌসুমে ত্রিমুকুট জিতিয়েছেন শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রকে। যেকোনো বিচারেই বাংলাদেশের ফুটবলে এ এক এভারেস্ট জয়ের মতো সাফল্য। দেশের প্রথাগত কোচিংকে দূর অতীতে ঠেলে দিয়েছেন আধুনিক ফুটবল মানস দিয়ে। তাঁর মতে ফার্গির সাফল্যের পেছনে ক্লাবের সার্বিক সহায়তার বড় অবদান। অবশ্য খেলোয়াড় চেনার জহুরি চোখও ছিল তাঁর। আর ছিল ধৈর্য। মারুফুল চোখের আতশি কাচে দেখেন মরিনহোর অনুশীলন-পদ্ধতি, যেটি এই পর্তুগিজকে সবার চেয়ে রেখেছে আলাদা করে। গার্দিওলার মধ্যে মারুফুল খুঁজে পান খেলোয়াড়দের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়ার অদ্ভুত গুণ, ক্লাব দর্শনকে (টিকি-টাকা) ধর্মের মতো অনুসরণ করে যাওয়া। আর স্কলারিকে নিজের বেঁধে নেওয়া লক্ষ্যে পৌঁছে দেয় তাঁর অভ্রভেদী ব্যক্তিত্ব। তবে রণকৌশলের কথা যদি বলেন, আর কেউ নন, আর্সেনালের আর্সেন ওয়েঙ্গারই পছন্দ মারুফুলের।

বাংলাদেশে প্রথাগত ফুটবল কোচিংয়ের এক পথিকৃৎ গোলাম সারোয়ার টিপু। ১৯৮৭ সালে একটি কোচিং কোর্স করতে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ফার্গুসন তখন মাত্রই এক বছরের পুরোনো। ইউনাইটেডের একটি সেশনেই দেখেছিলেন তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আর দলের ওপর অসামান্য নিয়ন্ত্রণ। মনে মনে মার্কা মেরে রেখেছিলেন—এই কোচ অনেক দূর যাবেন। কিন্তু একই উদ্দীপনা নিয়ে সাড়ে ২৬ বছর ইউনাইটেডকে ১৩টি লিগ, ১০টি চ্যারিটি শিল্ড, ৫টি এফএ কাপ, ৪টি লিগ কাপ, ২টি করে চ্যাম্পিয়নস লিগ ও বিশ্ব ক্লাব কাপ, একটি করে কাপ উইনার্স কাপ ও ইউরোপিয়ান সুপার শিরোপা জিতিয়ে তবেই অবসর নেবেন ভাবতে পারেননি। কোচ হলেন সমুদ্রে ভেসে চলা একটা জাহাজের ক্যাপ্টেনের মতো। স্রোত আর ঢেউ দেখে যিনি জাহাজ চালিয়ে নিতে পারবেন, সাফল্য তাঁকেই ধরা দেবে। ফার্গি সেটি পেরেছিলেন। ফার্গির কারণে ইংলিশ লিগই আজ একটা ব্র্যান্ড।

গোলাম সারোয়ার মরিনহোর মধ্যে দেখেন দুর্দান্ত ট্যাকটিক্যাল জ্ঞান আর তারকা খেলোয়াড় ব্যবস্থাপনার জাদুকরি এক ক্ষমতা। তাঁর চোখে গার্দিওলা এমন এক ব্যক্তিত্ব যাঁকে খেলোয়াড়েরা শুরু থেকেই ভেবে নেন একান্ত আপন।

কিন্তু সেসব ফুটবল কোচ, নির্দিষ্ট করে বললে সাফল্যকে যাঁরা আটপৌরে বানিয়ে ফেলেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্য কিছু আছে। যেটি দেখা যায়, চেনার পথ পাওয়া যায় না। জিনেদিন জিদান সবে পা ফেললেন আনচেলত্তির পাশে, সহকারী হিসেবে। একদিন প্রধান কোচ হিসেবে জিজুর মাথা ছোঁবে হয়তো আকাশ। অনেক সাফল্য চকখড়ি আঁকবে তাঁর নামের পাশে। আসলেই পারবেন? খেলা আর কোচিং যে ফুটবলের দুটো ভিন্ন দিক।