এখনো ব্যথা অনুভব করেন আরমান

২০০৩ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ে আরমানের ছিল দারুণ ভূমিকা। ছবি: এএফপি
২০০৩ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ে আরমানের ছিল দারুণ ভূমিকা। ছবি: এএফপি

সৈয়দ নঈমুদ্দিনের ওপর প্রচণ্ড রাগ আরমান মিয়ার। ভারতীয় ফুটবলের ‘দ্রোণাচার্য’ খ্যাতি পাওয়া বিখ্যাত এই ফুটবল কোচ তাঁকে নিয়ে ভারতীয় ফুটবলারদের মধ্যে এমন আতঙ্ক তৈরি করেছিলেন, তাঁর দুই পায়ের ভবিষ্যৎই পড়ে গিয়েছিল হুমকির মুখে। ২০০৫ সালে পাকিস্তানের মাটিতে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতীয় ফুটবলাররা তাঁকে বানিয়েছিল রীতিমতো ফাউলের ‘টার্গেট।’

বাংলাদেশের ফুটবলে ‘প্লে-মেকার’ কথাটার সার্থক প্রতিরূপ ছিলেন। আরমান মিয়া এ দেশের ফুটবলে সেই সব বিরল প্রতিভাদের একজন, যাঁর একজন উত্তরসূরির জন্য এখনো হাহাকার এ দেশের ফুটবলে।
দীর্ঘদিন জাতীয় দলে খেলেছেন। সময়ের হিসেবে ১৯৯৩ থেকে ২০০৬। ফুটবল মাঠে সৃষ্টিশীলতা দিয়ে নিয়েছিলেন আলাদা একটা জায়গাই। গুটি গুটি পায়ে প্রতিপক্ষের সীমানার দিকে বল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া, বলের ওপর দারুণ দখল। এদিক-ওদিক ডজ দিয়ে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে বোকা বানানো—আরমানের পর বাংলাদেশের আর কোন ফুটবলারের খেলায় এমন দৃশ্য ফুটবলপ্রেমীরা দেখতে পেয়েছেন খুব কমই।
২০০৩-০৪ সালের দিকে ব্রাদার্স ইউনিয়নে খেলেছিলেন আরমান। ভারতীয় কোচ সৈয়দ নঈমুদ্দিনকে কোচ বানিয়ে ব্রাদার্স সেবার প্রথমবারের মতো জিতেছিল ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা। বাংলাদেশ থেকে গিয়ে নঈমুদ্দিন দায়িত্ব পান ভারতের জাতীয় দলের। সমস্যাটার শুরুটা এখানেই। করাচির সাফ চ্যাম্পিয়নশিপকে সামনে রেখে নঈমুদ্দিন তাঁর শিষ্যদের সামনে আরমানের নাম এতবার উচ্চারণ করেছিলেন, একটা সময় ভারতীয় ফুটবলাররা তাঁকে ফাউলের লক্ষ্যই বানিয়ে ফেলেছিল।
২০০৫ সাফে ফাইনালে উঠেও ভারতের কাছে হেরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। সে ম্যাচে শুরুতেই ভারতীয় এক ফুটবলার আরমানকে করে বসেন ভয়ংকর এক ফাউল। হাঁটুর ব্যথায় মাঠে শুয়ে যখন আরমান কাতরাচ্ছেন, ঠিক তখনই ভারতের সেই ফুটবলারের মন্তব্য শুনতে পেলেন। হিন্দি ভাষাটা একটু-আধটু বোঝেন। আরমানের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, ওই ফুটবলারটি তাঁর এক সতীর্থকে বলছিলেন, ‘নঈম স্যারের মুখে খালি শুনি আরমান! আরমান!! দেখলাম ব্যাটার হাঁটুর জোর কত!’
সৈয়দ নঈমুদ্দিনের ওপর কপট একটা অভিমান থাকলেও উপমহাদেশের অন্যতম সেরা এই ফুটবল-ব্যক্তিত্বের প্রতি আরমানের অগাধ শ্রদ্ধা, ‘আসলে সৈয়দ নঈমুদ্দিন আমাকে খুব পছন্দ করতেন। ব্রাদার্সে খেলার সময় দেখেছি আমার সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা ছিল তাঁর। খুব ভরসা রাখতেন।’
লম্বা ক্যারিয়ারে তিনটি সাফ খেলেছেন। ১৯৯৭ সালে কাঠমান্ডুর প্রথম সাফ দিয়ে শুরু। মাঝে কেবল ১৯৯৯ সালে গোয়ার আসরটিতে খেলেননি। ২০০৩ সালে বাংলাদেশের সাফ বিজয়ে রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ২০০৫ সালের করাচি সাফে দলকে ফাইনালে তুলেও শিরোপা জিততে না পারার দুঃখটা আজও ভোলেননি, ‘২০০৩ সালে আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম, পরেরবার ২০০৫ সালে আমরা চ্যাম্পিয়ন দলের মতোই রাজত্ব করেছি পুরো প্রতিযোগিতায়। কিন্তু ফাইনালে যেন কী হলো। বাইচুং ভুটিয়ার কাছেই হেরে গেলাম আমরা।’
আরমানের মতে, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের সাফল্যের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে ছিলেন বাইচুংই, ‘বাইচুং অসাধারণ এক ফুটবলার। তাঁর অসাধারণত্বের কাছেই আমরা বারবার মার খেয়েছি। ১৯৯৯ সালে আমি দলে ছিলাম না, কিন্তু দেখেছি বাইচুংয়ের ক্ষণিকের ঝলক কীভাবে বাংলাদেশকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দিল। ২০০৫ সালে মাঠে থেকেই দেখলাম বাইচুং কী জিনিস!’
২০০৩ সালে দেশের মাটিতে সাফ জয়টাকে নিজের ক্যারিয়ারেরই বড় অর্জন হিসেবে দেখেন আরমান। ফুটবলার হিসেবে দেশকে একটা সাফল্য দিতে পারার ব্যাপারটিও তাঁকে স্বস্তি দেয়, ‘কম দিন তো আর খেললাম না। আমাদের অর্জন কী বলুন! ১৯৯৫ সালে মাদ্রাজ (এখন চেন্নাই) সাফ গেমসে ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে গিয়ে খুব খারাপ লেগেছিল। পুরো ম্যাচে এত ভালো খেলেছিলাম, কিন্তু প্রথমার্ধে আমাদের রক্ষণভাগের একটা ভুলেই সর্বনাশ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯৭ সালে কাঠমান্ডু সাফে তো বাজে ব্যর্থতাই সঙ্গী আমাদের। ভারতের বিপক্ষে গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচটায় প্রথম ৭৩ মিনিট এক চেটিয়া খেলেও ৩-০ গোলে হারার ঘটনা আছে। একটা পর্যায়ে হতাশা ভর করেছিল। ফুটবলার হিসেবে পরিচয় দিতেই খুব লজ্জা লাগত। ২০০৩ সালে সেই হতাশাটা দূর হয়েছিল। ২০০৫ সালে করাচিতে সাফল্য পেলে হয়তো আরও অনেক বেশি তৃপ্তি নিয়ে ক্যারিয়ারটা শেষ করতে পারতাম।’
দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা প্লে-মেকারের কণ্ঠে ফুটবলের সাফল্যহীনতার হাহাকারটাই যেন বেরিয়ে আসে এ কথায়। পায়ের ব্যথা ভুলেছেন আগেই। হৃদয়ের ব্যথা যেন আরমানের আজীবনের সঙ্গী!