সর্বোচ্চ গোলদাতার ট্রফি আর বিদেশি সাবান-শ্যাম্পু, দুটিই তার বড় পুরস্কার!

সর্বোচ্চ গোলদাতার ট্রফি হাতে তহুরা খাতুন। ছবি: প্রথম আলো।
সর্বোচ্চ গোলদাতার ট্রফি হাতে তহুরা খাতুন। ছবি: প্রথম আলো।

এলাকায় সবাই তাকে মেসি বলেই ডাকে। ময়মনসিংহ থেকে একবার টাঙ্গাইলে খেলতে গিয়েছিল তহুরা খাতুন। কলসিন্দুর গ্রামের এই কিশোরীর খেলা দেখে মুগ্ধ দর্শকেরা তাকে ‘মেসি’ খেতাব দিয়েছিল। সেই তহুরাই আবারও পেল ‘মেসি’ খেতাব।

তবে এবার দেশে নয়। সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে তাজিকিস্তানে খেলতে গিয়েছিল বাংলাদেশ। গত ২৬ এপ্রিল থেকে ১ মে দুশানবেতে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ মেয়েদের ফুটবলের আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে তহুরার খেলা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন এএফসি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে তাজিকিস্তানের সাধারণ দর্শকেরাও।

বাংলাদেশকে টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন করার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল তহুরার। গ্রুপ পর্ব থেকে শুরু করে ফাইনাল পর্যন্ত ৪ ম্যাচে করেছে ১০ গোল। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারটাও জিতে নিয়েছে এই মিডফিল্ডার।

দুশানবের যে হোটেলে উঠেছিল বাংলাদেশ, ওই হোটেলের কর্মকর্তা, কর্মচারীরা তো বটেই, সেখানে বাংলাদেশের লিয়াঁজো অফিসার থেকে শুরু করে, গাড়ির চালক পর্যন্ত সবাই তহুরায় মুগ্ধ। বাংলাদেশের খেলা থাকলে কিছু দর্শক শুধু তহুরার খেলা দেখতেই নাকি মাঠে আসত।

টুর্নামেন্টের পুরস্কারের পাশাপাশি এত এত দর্শকের ভালোবাসায় মুগ্ধ তহুরা বলছিল, ‘আমি এত ভালোবাসা পেয়েছি, যা ভুলতে পারব না কোনো দিন। আমার খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাজিকিস্তানের এক দর্শক বিদেশি সাবান আর শ্যাম্পু উপহার দিয়েছে।’

গত বছর নেপালে হওয়া এএফসির এই টুর্নামেন্টে তহুরা মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছিল খুব কম সময়। ভুটান ও ভারতের সঙ্গে মাত্র কয়েক মিনিট খেলতে পেরেছিল। সেবার ভুটানের সঙ্গে তারপরও একটি গোল দিয়েছিল।

এবার তাই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল তহুরা, ‘আমি এবার অনুশীলনে খুব সিরিয়াস ছিলাম। আগেই জানতাম এবার সানজিদা আপুরা খেলতে পারবে না। আমি সুযোগ পাবই।’

টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্বে ভারতের সঙ্গে ৩-১ গোলে জেতে বাংলাদেশ। ওই ম্যাচে তহুরা করেছিল জোড়া গোল। এরপর নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশ জেতে ৯-০ ব্যবধানে। ওই ম্যাচেও তহুরা জোড়া গোল করে। সেমিফাইনালে তাজিকিস্তানকে ৯-১ গোলে উড়িয়ে দেওয়ার ম্যাচে তহুরা করেছিল হ্যাটট্রিক। এরপর ফাইনালেও হ্যাটট্রিক করে তহুরা।

প্রতিপক্ষকে এত এত গোল দাও, মায়া লাগে না? প্রশ্নটা করতেই তহুরার হাসিমাখা উত্তর, ‘খেলতে নেমে মায়া করতে নেই। আমি গোল করেই আনন্দ পাই।’

অথচ এই তহুরাকে শুরুতে ফুটবল খেলতে দিতে চাননি কৃষক বাবা ফিরোজ মিয়া। বলতেন, ‘মেয়ে হয়ে জন্মেছিস, খেলে কী লাভ হবে?’ কিন্তু কলসিন্দুর স্কুলের মাঠে তহুরা তখন বড় আপুদের খেলা চেয়ে চেয়ে দেখত।

একদিন এক আপু বলেছিল, ‘তহুরা, তুই কি খেলতে চাস? স্যারকে বলি তাহলে।’ স্কুলের শিক্ষকের সহযোগিতায় এরপর বাবা-মায়ের কাছ থেকে খেলার অনুমতি মেলে তহুরার। বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন কলসিন্দুরের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতে তহুরা।

কিন্তু আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে জেতা ট্রফিটার মূল্য তহুরার কাছে অনেক। তাই তো বিমান থেকে নেমে ট্রফিটা সেই যে কোলে আঁকড়ে রেখেছে, সেটা যেন হাতছাড়াই করতে চায় না।

ছেলেদের মতো তহুরার চুলগুলো ববকাট। তাজিকিস্তানে গিয়ে দলের সহকারী কোচ মাহবুবুর রহমান লিটুকে বলত, ‘স্যার, আজ আমার চুল ধরে টানলেন না! আপনি চুল না টানলে গোল পাব না।’ কোচও মজা করে প্রতি ম্যাচের আগে চুল ধরে আদরের টান দিতেন। তহুরা দেশে ফেরার সময় সর্বোচ্চ গোলদাতার ট্রফিটা এনেছে। এনেছে সেই বিদেশি সাবান আর শ্যাম্পু। এ যে ভালোবেসে দেওয়া এক বিদেশির উপহার। নিজের খেলা দিয়ে এক বিদেশির মন জিতেছে, এর মূল্যও কি কম?