'অধিনায়কের' আলো

আজীবন সম্মাননা পাওয়া দু্ই কিংবদন্তি জাকারিয়া পিন্টু ও সুফিয়া খাতুন l প্রথম আলো
আজীবন সম্মাননা পাওয়া দু্ই কিংবদন্তি জাকারিয়া পিন্টু ও সুফিয়া খাতুন l প্রথম আলো

কয়েক দিন ধরেই তাঁর যেন আর সময় কাটছিল না। কখন আসবে সেই ক্ষণ! কখন তাঁকে মঞ্চে ডাকা হবে। কখন হাতে তুলবেন রূপচাঁদা-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা ২০১৪। অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, আলোকিত মঞ্চে উঠলেন জাকারিয়া পিন্টু।
আবেগে থরথর তাঁর কণ্ঠ। নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে পারলেন, ‘আমি সত্যিই আজ খুব আনন্দিত। এত দিন দর্শকসারিতে বসেছিলাম এই পুরস্কার অনুষ্ঠানে। আজ নিজেই সম্মানিত হলাম। জীবনে এ দিনটি কখনো ভোলার নয়।’
জাকারিয়া পিন্টুকেও কখনো ভুলবে না এ দেশের ক্রীড়াঙ্গন, কখন যে এত এত মাইলফলক গড়ে ফেলেছেন টেরই পাননি! ৭৩ বছরের জীবনে তাঁকে কোন পরিচয়ে পরিচিত করবেন? ধাঁধায় পড়তে হয়। ফুটবলজীবনের প্রতিটি ধাপে গড়েছেন রেকর্ড। নয় নয় করে সেই রেকর্ডের সংখ্যা ছয়। তিনি অধিনায়কদেরও অধিনায়ক!
সেসব নিয়ে দুই দিন আগে মোহামেডান ক্লাবে দাঁড়িয়ে খুলে দিয়েছিলেন স্মৃতির ঝাঁপি। নওগাঁ থেকে উঠে এসে ফুটবলে পা রাখলেন, তাঁকে ডাক্তার বানাতে বাবার সব চেষ্টা ব্যর্থ করে কীভাবে ১৯৫৭ সালে ইস্ট এন্ড ক্লাব দিয়ে ঢাকার ফুটবলে নেমে পড়া। গল্পের ঝাঁপি খুলে কখনো হাসেন, কখনো ফুটবল মাঠে কোনো এক বিকেলে দাঁত পড়ে যাওয়ার গল্প শোনান! আবার কখনো রসিকতা ঝরে, ‘আরে, আমি তো বাসররাতে বউ ফেলে খেলতে চলে গিয়েছিলাম!’
১৯৬১-৭৫ টানা ১৫ বছর মোহামেডানে খেলার গর্ব তাঁকে ছুঁয়ে যায়। ’৬৮ থেকে টানা আট বছর মোহামেডানের অধিনায়কত্ব করার অহংকারও তাঁর সঙ্গী। ’৭৩ মারদেকায় যাওয়া বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় দলের অধিনায়ক পরিচয়টাও অনেক বড়। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলে নিজেকে তুলে নিয়েছেন অন্য উচ্চতায়। তবে জাকারিয়া পিন্টুকে পরিমাপ করার সবচেয়ে বড় তথ্য—স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়কের চিরগর্বের মুকুটটা যে তাঁরই মাথায়।
সেসব অর্জনের সঙ্গে কাল যখন আরেকটি মালা গলায় পরলেন, জাকারিয়া পিন্টু নিজেকে ভাবেন ভাগ্যবান এক ক্রীড়াবিদ, ‘খেলাধুলায় এসে যে ভুল করিনি জীবনে তা আরেকবার বুঝলাম। অনেক তো পেলাম, কিন্তু এই আজীবন সম্মাননার কোনো তুলনা হয় না।’ বলতে বলতে তাঁর চোখ ছলছল করে ওঠে। দীর্ঘদিনের সহযাত্রী বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের আরেক দিকপাল প্রতাপ শংকর হাজরা পাশে দাঁড়িয়ে শুধু বলে যান, ‘যোগ্য লোকটিকে সম্মানিত হতে দেখে নিজেকেও সম্মানিত লাগছে।’
হল রুম ছেড়ে যাওয়ার সময় তাঁকে অভিনন্দন জানানোর স্রোত বইল। জাকারিয়া পিন্টুর চোখমুখ তখন চিকচিক করছিল। অলক্ষ্যে একটু আনন্দাশ্রুও।