সমতল পৃথিবীর সুযোগ নেওয়ার সময় এখনই

যেকোনো জায়গায় বসেই এখন দূরের কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির জন্য কাজ করে দেওয়া যায়। অনলাইনে অর্ডার জানিয়ে পণ্যও পৌঁছে দেওয়া যায় পৃথিবীর যেকোনো স্থানে l ছবি: প্রথম আলো
যেকোনো জায়গায় বসেই এখন দূরের কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির জন্য কাজ করে দেওয়া যায়। অনলাইনে অর্ডার জানিয়ে পণ্যও পৌঁছে দেওয়া যায় পৃথিবীর যেকোনো স্থানে l ছবি: প্রথম আলো

সেদিন ছিল এক বিয়ে। আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের। ঢাকায়। আমি থাকি অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। যেহেতু ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, কিছু তো একটা করতেই হয়! ভাবলাম, মিষ্টি আর ফুল পাঠালে কেমন হয়। যেই কথা সেই কাজ। ২০ ডলারের মিষ্টি আর এক তোড়া ফুল পৌঁছে গেল সুসজ্জিত মোড়কে, যথাস্থানে এবং যথাসময়ে।

না! এর জন্য আমাকে মেলবোর্ন থেকে ঢাকা যেতে হয়নি। ঢাকায় কোনো আত্মীয়ের শরণাপন্নও হতে হয়নি। কাউকে টাকাও পাঠাতে হয়নি। ইন্টারনেটে টাকা আর উপহারের তালিকা পৌঁছে গেছে মুহূর্তে। আর জিনিস পৌঁছে গেছে যথাস্থানে, যথাসময়ে। সঙ্গে আমার নাম খোদাই করা একটি কার্ডও গেছে।

এত কিছু ঘটে গেল, কিন্তু সবাই নিজ নিজ স্থানে রয়ে গেলাম। আমি মেলবোর্নে। আমার আত্মীয় ঢাকায় বিয়ের মঞ্চে। আর ঢাকার মিষ্টি ও ফুল ঢাকাতেই। আর এর মানে হলো গোলাকার পৃথিবীর সমতল হয়ে যাওয়া।

এতে কী ঘটে গেল? রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হয়ে গেল কুড়ি ডলারের ব্যবসা। এক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। এর প্রভাবই বা কী? প্রথমত, ঢাকায় কুড়ি ডলার পৌঁছে গেল। ফলে ফুল ও মিষ্টির চাহিদা বাড়ল। বাড়ল মোড়কে ব্যবহৃত রঙিন কাগজ ও কার্ডের চাহিদা। মানুষের কর্মসংস্থান বাড়ল, সেই সঙ্গে নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলো। সর্বোপরি বাড়ল মানুষের আয়। এটা একটা উৎকর্ষ চক্র। এটাই আজকের বাজারে বাজার অর্থনীতির মূল চাবিকাঠি।

এখানেই শেষ কথা নয়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রভাবিত করে সামাজিক সূচক। মোড়কে মিষ্টি ও ফুল পৌঁছে দিতে হবে সুন্দরভাবে। যে চালক বা ব্যক্তি পৌঁছে দেবেন, তাঁর অক্ষর ও সময়জ্ঞান থাকতে হবে। তাঁকে হতে হবে তুলনামূলকভাবে স্মার্ট। আর সেবা প্রদানের এ ব্যবসা দীর্ঘকালের জন্য ধরে রাখতে তাঁকে হতে হবে বিশ্বস্ত। এককথায়, জ্ঞান, রুচি, সময়ের ধারণা ও নৈতিকতা—এসব আজকের বাজারে অর্থনৈতিক উন্নতি লাভ এবং তা টিকিয়ে রাখার জন্য ন্যূনতম মাপকাঠি। এখানেই প্রয়োজন দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসা; সঠিক মানবসম্পদ গড়ার কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখা।

পৃথিবী এখন ‘সমতল’ বলেই আজ আর কলম্বাসকে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিতে হয় না মণি, মুক্তা আর স্বল্পমূল্যের কুন্টাকিন্টের (আলেক্স হাইলির রুটস উপন্যাসের প্রধান চরিত্র) শ্রমের জন্য। ভাস্কো ডা গামাকে আজ আর ভারত উপমহাদেশে আসতে হয় না সিল্ক আর মসলার জন্য। ক্যাপ্টেন কুককেও আসতে হয় না অস্ট্রেলিয়ার এ প্রান্তে, প্রশান্ত মহাসাগরের দীপপুঞ্জে। আজ অনায়াসেই পৃথিবীর আনাচকানাচে পৌঁছে যাচ্ছে চীনের শ্রম, বাংলাদেশের বস্ত্র-বালিকার শ্রম, ভারতের মসলা—এমনকি বলিউডি বিনোদনও।

বিদেশিরা বল প্রয়োগে আমাদের সম্পদ ও শ্রম লুট করেছে। আমরা তাকে বলি শোষণ। আজ স্বেচ্ছায় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সস্তা শ্রম দিতে আগ্রহী সেই একই শোষক শ্রেণির কাছে। তাকে কী বলব? এ কি নিও-কলোনিয়ালিজম? পরিহাসের বিষয়, তা হলেও এটাই আজ উন্নতি ও সমৃদ্ধির উৎকৃষ্ট কৌশল। চীন, ভারত এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বস্ত্র ও চামড়াশিল্প ছাড়িয়ে সফটওয়্যার প্রকৌশল এবং সার্ভিস আউটসোর্সিং সেবা দিতে বাংলাদেশও সক্ষম। গত দেড় দশকজুড়ে ভারতের জাতীয় প্রবৃত্তির হার ছিল ৫ থেকে ৯ শতাংশ। চীনে গত আড়াই দশকে এ হার ছিল তারও বেশি। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ আকার, শক্তি ও অর্থনীতিতে বড় এই দুটি দেশের মাঝখানে অবস্থিত। তাদের মতো আমরা কি সমতল পৃথিবীর সুযোগ নেব না? ব্রেইন ড্রেইনকে ব্রেইন গেইনে রূপান্তরে দেশে যে পরিবেশ প্রয়োজন, তা সৃষ্টি করতে পারছে কি বাংলাদেশের সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান?

টিক চিহ্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান নাইকির লোগো। নাইকির ব্যবস্থাপক শুধু তাদের দ্রব্যাদি ক্রেতার কাছে আকর্ষণীয় করে তোলা আর নকশা তৈরিতে ব্যস্ত। লন্ডন কিংবা নিউইয়র্কের হাইস্ট্রিটের কোনো অফিসে বসে তৈরি হয় নকশা আর বাজারজাতকরণের পরিকল্পনা। আর পণ্য তৈরি হয় স্বল্পমূল্যের শ্রমে হাজার হাজার মাইল দূরে ইন্দোনেশিয়া কিংবা ভিয়েতনামে। যা আবার বিক্রি হয় লন্ডন কিংবা নিউইয়র্কের হাইস্ট্রিটের কোনো মলে।

প্রবাসী বাঙালিরাও পারেন এ ধারণা প্রয়োগ করতে। ধরুন, প্রবাস থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা। পত্রিকা বা ওয়েবসাইটের ডিজাইনের কাজ হলো প্রবাসে বসে। ছাপার যাবতীয় কাজ হলো বাংলাদেশের কোনো এক ছোট শহরে। আর তা ইন্টারনেটের মাঝে ত্বরিত বেগে আবার পৌঁছে যাবে প্রবাসে প্রকাশনার জন্য। হতে পারে কি এমন কিছু? এটা একটি ছোট উদাহরণ মাত্র। এই একই ধারণায় এ ধরনের আরও হাজারো ছোট ও মাঝারি মাপের ব্যবসা সম্ভব।

আমার আত্মীয়ের বিয়ের উপহারের কথা ভাবুন। বাংলাদেশের মিষ্টি ও ফুল বাংলাদেশেই কেনাবেচা ও ব্যবহৃত হলো। অথচ তাতে এক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংগঠিত হলো। আবার বাংলাদেশের মফস্বল শহরের সেই মেয়েটি, যে ঘরে বসেই মুদ্রণকাজের মাঝে তার শ্রম বিক্রি করল আন্তর্জাতিক বাজারে। মাইকেল পোর্টারের ‘প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা’ কৌশলের সদ্ব্যবহার করার সুযোগ আগে এত ব্যাপকভাবে আর কখনো আসেনি।

পিথাগোরাসের আগে মানুষ না জেনে বলেছে, পৃথিবী সমতল। সে ছিল মানুষের অজ্ঞতা। আজ মানুষ জেনে বলছে, পৃথিবী সমতল, এ মানুষের যোগ্যতা। সমতল পৃথিবীর সুযোগ নেওয়ার এটাই শ্রেষ্ঠ সময়।

লেখক: অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ও গবেষক