সবুজ ডাকপিয়নের এরা এত পাগল!

হোয়াটসঅ্যাপ
হোয়াটসঅ্যাপ

বালিতে বালি কম, স্কুটার বেশি। রাস্তায় বেরোলেই চোখে পড়বে পিঁপড়ের সারির মতো স্কুটারচালকদের লাইন। দুই চাকার বাহন এখানে এতটাই জনপ্রিয়, আমাদের চেনা মোটরসাইকেলগুলোর একটির দেখাও মিলল না।

বালিতে স্কুটারের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় সম্ভবত হোয়াটসঅ্যাপ। উঠতে, বসতে, খেতে...এমনকি স্কুটার চালাতে চালাতেও এটা হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা আদান-প্রদান করে। স্কুটারগুলোর ক্লাচ নেই, ফলে এক হাতেই গতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এমন দৃশ্য তাই চোখে প্রায় পড়ে—এক হাতে স্কুটার চালাতে চালাতে অনেকে ব্যস্ত হোয়াটসঅ্যাপেও!

মোটরসাইকেলে পেছনে বসে টাইপ করা কঠিন হওয়ার কথা। আর এরা কিনা চালাতে চালাতেই টাইপ করে! এতটাই হোয়াটসঅ্যাপ পাগল ইন্দোনেশিয়ার মানুষ। পরশু (রোববার) বালির বিমানবন্দরে এসে পৌঁছানোর পর এই উন্মাদনার সঙ্গে পরিচয়। সিঙ্গাপুরেও ‘সবুজ ডাকপিয়ন’টার বেশ কদর দেখেছি। মেট্রোতে, পার্কে, বেঞ্চিতে সবাই মাথা নিচু করে বসে টুকটুক করে ছোঁয়াপর্দায় টাইপ করে চলেছে। ‘মাথা উঁচু করে বাঁচার’ দিন বোধ হয় সারা পৃথিবীতেই ফুরিয়ে আসছে।

তবে দ্বীপ রাজ্য বালিতে আসার পর এ নিয়ে একটা উত্তাপ টের পাচ্ছি। কারণ, দেশটির সরকার ৪৮ ঘণ্টার চূড়ান্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল হোয়াটসঅ্যাপকে। পূরণ করতে বলেছিল একটি শর্ত।

সাত কোটি মানুষ এই দেশে মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহার করেন। এর মধ্যে কাউকে ফেসবুক মেসেঞ্জার বা ভাইবার ব্যবহার করতে দেখার সৌভাগ্য হলো না। এরা ভিডিওও শেয়ার করে হোয়াটসঅ্যাপে! রেস্তোরাঁয় চামচের টুংটাংয়ের চেয়ে মোবাইলে বার্তা হাজির হওয়া টিং শব্দ বেশি শোনা যায়। বাংলাদেশে ফেসবুকের প্রায় তিন গুণ হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারী এখানে। অবশ্য দেশটাও ২৬ কোটি জনসংখ্যার।

ইন্দোনেশিয়া জনসংখ্যার দিক দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ। এখানকার আইনকানুন বেশ কড়া। যদিও পর্যটনশিল্পের কথা ভেবে বালিতে তারা বেশ ছাড় দিয়ে রেখেছে। কিন্তু দেশটি সামাজিক নীতিবোধের জায়গায় বেশ কড়া। পর্নোগ্রাফি এখানে নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ বিভিন্ন ডেটিং ওয়েবসাইট, এমনকি যৌনশিক্ষার সাইটও।

হোয়াটসঅ্যাপের ওপর খেপেছিল এ কারণে, বার্তা হিসেবে এমন অনেক জিফ (প্রায় চলন্ত খুদে ছবি) পাঠানো হয়, যেগুলো ইন্দোনেশিয়ার পর্নোগ্রাফি আইন ভঙ্গ করে। দেশটির সরকার ঘোষণা দিয়েই ইন্টারনেট জঞ্জাল পরিষ্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় বলেই হয়তো সেটা দিয়ে কর্মসূচি শুরু করতে চেয়েছে সরকার। একই বার্তা গুগল, ফেসবুকদেরও দেওয়া হয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপ অবশ্য ফেসবুকেরই সহযোগী প্রতিষ্ঠান।

ফলে সোমবার যখন খবর ছড়িয়ে পড়ল, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ হয়ে যেতে পারে; একধরনের চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছিল। হোয়াটসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষ তাদের বড় এই বাজার হাতছাড়া করতে চায়নি। দ্রুত তারা ইন্দোনেশিয়ার সরকারকে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। বলেছে, জিফ সুবিধাটা সরাসরি হোয়াটসঅ্যাপ দেয় না। এগুলো বানায় ও পরিচালনা করে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে কাজ করা বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। আর হোয়াটসঅ্যাপের বার্তা যেহেতু সুরক্ষিত (এনক্রিপটেড), এগুলোর ভেতরে ঢুকে নিয়ন্ত্রণ করা তাদের পক্ষেও সম্ভব নয়।

তৃতীয় পক্ষ, প্রতিষ্ঠানগুলো অবশ্য এরই মধ্যে নড়েচড়ে বসেছে। টেনর নামের জিফ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটির ছবিগুলো আর ইন্দোনেশিয়া থেকে দেখা যাবে না। জিফ আগে থেকেই ফিল্টার সুবিধা দেয়, যার ফলে হোয়াটসঅ্যাপ সহজে তা বন্ধ করে দিতে পেরেছে। আর সরকারও ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম তুলে নিয়েছে।

ইন্দোনেশিয়া সরকার এই পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি আরও কিছুদিন চালাবে। যদিও সমালোচকেরা বলছেন, বজ্র আঁটুনির ফসকা গেরো থাকবেই। ইন্টারনেটে এভাবে দেয়াল তুলে নোংরা জিনিস প্রতিরোধ করা যায় না। কারণ, হাজারটা বিকল্প আছে। তারা বরং মনে করেন, নিষিদ্ধ করে কৌতূহল বাড়িয়ে দেওয়ার বদলে এ সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা ও সচেতনতা তৈরি ভালো বিকল্প।

কে জানে, কার কথা ঠিক। আপাতত এই কদিনে জুটে যাওয়া আমার ইন্দোনেশিয়ান বন্ধুদের হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠাতে পারব, তাতেই আমি খুশি। শুধু আফসোসটা থেকে গেল, লোকে যে বলে আমি ফেসবুক সেলিব্রিটি, তা তারা টের পেল না!