প্রাণী নয়, মাংস দেবে গবেষণাগার!

মেম্ফিস মিটের গবেষণাগারে উৎপাদিত মাংস। প্রাণিদেহ থেকে প্রাপ্ত মাংসের মতোই এর স্বাদ-গন্ধ। ছবি: রয়টার্স
মেম্ফিস মিটের গবেষণাগারে উৎপাদিত মাংস। প্রাণিদেহ থেকে প্রাপ্ত মাংসের মতোই এর স্বাদ-গন্ধ। ছবি: রয়টার্স

এমন এক বিশ্বের কল্পনা করুন, যেখানে পশু অধিকার আন্দোলনে সোচ্চার একজন কড়া নিরামিষভোজী প্রাণিকুলের প্রতি তাঁর ভালোবাসায় কোনো রকম চোট না দিয়ে এক টুকরো মাংসে কামড় বসাচ্ছেন! সেই নিরামিষাশীর মতো আরও অনেকেই মাংস খেলেও প্রাণিকুলের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। মানে, কোনো জীবনহানি ঘটছে না। ভাবছেন এ কীভাবে সম্ভব? মাংস খেতে চাইলে তো জীব হত্যা করতে হবে? হত্যা ছাড়া মাংস খাওয়া—যাহ! এ আবার হয় নাকি!

হয়। বিজ্ঞানে অনেক কিছুই হয়। এই বিজ্ঞানের বদৌলতেই ওপরের দৃশ্যকল্পটা এখন বাস্তব! প্রাণিজ আমিষ পেতে এখন আর পশু-প্রাণীর মাংসের ওপর নির্ভর না করলেও চলবে। গবেষণাগারে প্রাণিদেহের কোষ থেকে শতভাগ টাটকা মাংস তৈরির কায়দা বের করে ফেলেছেন গবেষকেরা। তাই একসময় নিরামিষাশীদের কাছে মাংস খাওয়া মানেই ‘প্রাণী হত্যা’র ধারণাটি এখন অতীত হতে চলেছে।
সানফ্রান্সিসকোর খাবার প্রযুক্তি ঘর ‘মেম্ফিস মিট’ এই বৈপ্লবিক পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছে। কোষ প্রকৌশলবিদ্যা কাজে লাগিয়ে তারা বের করেছে প্রাণিদেহের বাইরে মাংস তৈরির কৌশল। গরু, মুরগি কিংবা হাঁসের মাংস উৎপাদনে তাদের পশুপাখি পালতে হয় না কিংবা প্রাণী হত্যার দরকার পড়ে না। এর বদলে প্রতিষ্ঠানটির গবেষণাগারে তৈরি করা হচ্ছে শতভাগ টাটকা মাংস, যার স্বাদ-গন্ধ অবিকল প্রাণিদেহের মাংসের মতোই। মানে, খাঁটি মাংস আরকি!

গবেষণাগারে উৎপাদিত ‘মিট বল’। এর স্বাদ জিবে জল আনতে যথেষ্ট। ছবি: মেম্ফিস মিট
গবেষণাগারে উৎপাদিত ‘মিট বল’। এর স্বাদ জিবে জল আনতে যথেষ্ট। ছবি: মেম্ফিস মিট

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’-তে গড়ে প্রায় পাঁচ কোটি টার্কি (একধরনের পাখি) হত্যা করা হয়। টার্কির মাংস মার্কিনদের ভীষণ প্রিয়। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ইউরোপ কিংবা অন্যান্য দেশেও মাংসভোজী মানুষের সংখ্যা দিন দিন ঊর্ধ্বমুখী। প্রাণিকুল উজাড় না করেই মানুষের মাংসের চাহিদা মেটানোই এই প্রযুক্তি বৈপ্লবিক অবদান রাখবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। প্রযুক্তির বদৌলতে গবেষণাগারে উৎপাদিত এই মাংসের নাম ‘ক্লিন মিট’—যা অদূর ভবিষ্যতেই বাজারজাত করা হবে। ‘মেম্ফিস মিট’-এর পাশাপাশি এ ধরনের মাংস উৎপাদনে এগিয়ে এসেছে আরও কিছু প্রতিষ্ঠান।
প্রাণিদেহের যে কোষগুলো শরীরের বাইরেও পুনর্বিকশিত হতে পারে, সেসব কোষের কিছু নমুনা একটি বড় স্টিলের ট্যাংকের রেখে বিকাশ ঘটানো হয়েছে। প্রাণিদেহ থেকে প্রাপ্ত মাংসে প্রচুর ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া থাকে। কিন্তু ‘ক্লিন মিট’—প্রায় শতভাগ ব্যাকটেরিয়ামুক্ত। মাংস উৎপাদনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গৃহপালিত পশু-পাখি পালনে যে পরিমাণ জমি ও পানির দরকার হচ্ছে, ‘মেম্ফিস মিট’-এ সে তুলনায় পানি লাগছে শতকরা ১০ ভাগের ১ ভাগ এবং জমি ১০০ ভাগের ১ ভাগ!
বৈপ্লবিক এই প্রযুক্তিকে ইতিমধ্যেই জীববৈচিত্র্য অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত সংস্থাগুলো সাদরে গ্রহণ করেছে। পিপল ফর এথিক্যাল ট্রিটমেন্ট ফর অ্যানিমেলস (পিইটিএ) সংস্থাটি প্রযুক্তিটির প্রশংসা করে বলেছে, এতে প্রতিবছর কয়েক শ কোটি প্রাণীর জীবন রক্ষা পাবে। বিল গেটস এবং ব্রানসনের মতো ব্যক্তিত্ব ছাড়াও ‘মেম্ফিস মিট’-এ অর্থ লগ্নি করেছে বিশ্বের অন্যতম বড় কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কারগিল ইনকরপোরেশন। এ প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ প্রসঙ্গে ব্লুমবার্গকে ব্রানসনের ভাষ্য, ‘আমি বিশ্বাস করি, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে আমাদের আর প্রাণী হত্যার দরকার হবে না। সব ধরনের মাংস “ক্লিন” কিংবা “উদ্ভিজ্জ” পদ্ধতিতে তৈরি করা হবে, যেটার স্বাদ অবিকল একই রকম থাকবে এবং স্বাস্থ্যকরও।’