মহাবিশ্ব সম্পর্কে ধারণা

>

মহাবিস্ফোরণ থেকে কৃষ্ণগহ্বর পর্যন্ত মহাবিশ্বের ইতিহাস নিয়ে ধারাবাহিক বক্তৃতা দেন স্টিফেন হকিং। এই বক্তৃতায় তিনি তাঁর ভাবনার একটা রূপরেখা দেন। প্রথম বক্তৃতায় মহাবিশ্ব সম্পর্কে অতীতের ধারণাগুলো সংক্ষেপে বর্ণনা করেন তিনি। এই ধারাবাহিক বক্তৃতা প্রকাশিত হয়েছে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত স্টিফেন হকিং-এর দ্য থিওরি অব এভরিথিং বইয়ে।

স্টিফেন হকিং। ছবি: রয়টার্স
স্টিফেন হকিং। ছবি: রয়টার্স


পৃথিবী সমতল থালার মতো নয়, বরং গোলাকার একটি বস্তু। এটি বিশ্বাস করার সপক্ষে অনেক আগে, প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪০ সালে অ্যারিস্টটল অন্তত দুটি ভালো যুক্তি দেখাতে পেরেছিলেন। তাঁর লেখা অন দ্য হেভেন শিরোনামের একটি বইতে এসব যুক্তি তুলে ধরেছিলেন তিনি। প্রথমত, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সূর্য আর চাঁদের মাঝখানে পৃথিবী আসার কারণেই যে চন্দ্রগ্রহণ হয়। চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদের ওপর পৃথিবীর যে ছায়া পড়ে তা সব সময় গোলাকার দেখায়। একমাত্র পৃথিবীর নিজের আকার গোলাকার হলেই কেবল এটি সত্য হতে পারে। অন্যদিকে পৃথিবী যদি চাকতির মতো সমতল হত, তাহলে চাঁদের ওপর তার ছায়া হওয়া উচিত ছিল বিলম্বিত ও ডিম্বাকার। তবে সে ক্ষেত্রে সূর্য যদি এই সমতল চাকতির সরাসরি ওপরে কখনো অবস্থান করত, শুধু তখনই চাঁদের ওপর পৃথিবীর ছায়া গোলাকার দেখা যাওয়ার কথা।

দ্বিতীয়ত, দেশে-বিদেশে ভ্রমণের কারণে গ্রিকরা জানত, উত্তরের অঞ্চলগুলোর তুলনায় দক্ষিণের অঞ্চল থেকে ধ্রুবতারা আকাশে কিছুটা নিচের দিকে দেখা যায়। মিসর ও গ্রিসে ধ্রুবতারার আপেক্ষিক অবস্থানের পার্থক্য হিসাব করে অ্যারিস্টটল পৃথিবীর পরিধি আনুমানিক চার হাজার স্টেডিয়া বলে উল্লেখ করেছিলেন। এক স্টেডিয়ার দৈর্ঘ্য কতটুকু তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে এর পরিমাপ ২০০ গজ হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। এই হিসাবে পৃথিবীর পরিধির বর্তমানে স্বীকৃত দৈর্ঘ্যের চেয়ে দ্বিগুণ একটি সংখ্যা পেয়েছিলেন অ্যারিস্টটল।

অবশ্য পৃথিবী গোলাকার হওয়ার পেছনে গ্রিকদের কাছে নিঃসন্দেহে তৃতীয় আরেকটি যুক্তি ছিল। পৃথিবী যদি গোলাকার না হতো, তাহলে দিগন্ত থেকে উপকূলের দিকে এগিয়ে আসা কোনো জাহাজের প্রথমে পাল আর তার অনেক পরে মাস্তুল দেখা যায় কেন? অ্যারিস্টটল ভাবতেন, পৃথিবী স্থির এবং সূর্য, চাঁদ, গ্রহসমূহ ও অন্যান্য নক্ষত্র পৃথিবীকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে। তার এই বিশ্বাসের পেছনের কারণটি ছিল আধ্যাত্মিক। সে কারণেই তিনি উপলদ্ধি করেছিলেন, পৃথিবীই এই মহাবিশ্বের কেন্দ্র আর এ ক্ষেত্রে বৃত্তাকার গতিপথই হচ্ছে সবচেয়ে নিখুঁত।

অ্যারিস্টটলের এই ধারণাটি খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে আরও বিস্তারিতভাবে একটি সম্পূর্ণ মহাজাগতিক মডেলের ওপর দাঁড় করেছিলেন টলেমি। এই মডেলে পৃথিবীর অবস্থান ছিল একেবারে কেন্দ্রে আর তার চারদিকে ছিল আটটি গোলক। এসব গোলক চাঁদ, সূর্য, অন্যান্য নক্ষত্র এবং সেকালে জানা থাকা পাঁচটি গ্রহ-বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি বহন করত। এই মডেলে গ্রহগুলো নিজেরা আবার তাদের নিজ নিজ গোলাকার কক্ষপথের পাশে যুক্ত একটি ক্ষুদ্রাকার বৃত্তে ঘুরত। আকাশ পর্যবেক্ষণে পাওয়া গ্রহগুলোর জটিল পথের ব্যাখ্যা করতেই এমনটি করা হয়েছিল। টলেমির মডেলের একেবারে সর্বশেষ গোলকটি বহন করত তথাকথিত স্থির নক্ষত্রগুলোকে। এসব স্থির নক্ষত্র অন্যদের তুলনায় সব সময় একই জায়গায় স্থির থাকে এবং সব সময় একই সঙ্গে আকাশে আবর্তিত হয়। অবশ্য এই সর্বশেষ গোলকের পরে কী আছে, এই মডেলটিতে তা কখনোই স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। তবে সেখানে আর যাই হোক, মানবজাতির চর্মচক্ষে দেখা মহাবিশ্বের কোনো অংশ ছিল না নিঃসন্দেহে।

টলেমির এই মডেল আকাশের স্বর্গীয় বস্তুগুলোর অবস্থান আগাম অনুমানের মোটামুটি একটি সঠিক পদ্ধতি বাতলে দিতে পেরেছিল। তবে বস্তুগুলোর অবস্থান নির্ভুলভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে কিছু বিষয় অনুমান করে নিতে হয়েছিল টলেমিকে। যেমন তাঁকে ধরে নিতে হয়েছিল যে চাঁদ এমন এক কক্ষপথ অনুসরণ করে, যা চাঁদকে মাঝে মাঝে অন্য সময়ের চেয়ে পৃথিবীর দ্বিগুণ কাছে নিয়ে আসে। অর্থাত্ হিসাবমতে, সাধারণ সময়ের তুলনায় চাঁদকে মাঝে মাঝে দ্বিগুণ বড় দেখানো উচিত। অবশ্য নিজের মডেলের এই ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন টলেমি। কিন্তু তারপরও তাঁর মডেলটি সার্বজনীনভাবে না হলেও সাধারণভাবে সবাই গ্রহণ করেছিল। এদিকে মহাবিশ্বের চিত্র হিসেবে এই মডেলের সঙ্গে ধর্মগ্রন্থের মিল খুঁজে পেয়ে মডেলটিকে সমর্থন করেছিল খ্রিষ্টীয় গির্জা। কারণ মডেলটির সবচেয়ে বড় সুবিধাটি ছিল, স্থির নক্ষত্রগুলোর গোলকের বাইরে স্বর্গ আর নরক স্থাপনের জন্য বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা পাওয়া গিয়েছিল।

অবশ্য ১৫১৪ সালে এর চেয়েও সহজ একটি মডেলের প্রস্তাব করেছিলেন পোলিশ পাদরি নিকোলাস কোপার্নিকাস। শুরুতে কোপার্নিকাস ছদ্মনামে নিজের মডেলটি প্রকাশ করেছিলেন। কারণ প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী হওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার ভয়ে ভীত ছিলেন তিনি। তাঁর মডেলে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে সূর্য ছিল স্থির অবস্থায় আর পৃথিবী ও অন্য গ্রহগুলো বিভিন্ন বৃত্তাকার কক্ষপথে সূর্যের চারপাশে আবর্তিত হচ্ছে। কোপার্নিকাসের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, প্রায় এক শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়ার পরও সে সময় কেউই তাঁর এই ধারণাটিকে গুরুত্ব দেয়নি। এরপর দুজন জ্যোতির্বিদ প্রকাশ্যে কোপার্নিকাসের মতবাদ সমর্থন করতে শুরু করেন। এদের একজন হচ্ছেন জার্মান জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলার এবং আরেকজন ইতালিয়ান জ্যোতির্বিদ গ্যালিলিও গ্যালিলি। অবশ্য কোপার্নিকাসের মতবাদের মাধ্যমে কক্ষপথের যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, তা পর্যবেক্ষণের সঙ্গে নিখুঁতভাবে মিলত না। কিন্তু তারপরও কেপলার ও গ্যালিলিও এটি সমর্থন করেছিলেন। এভাবে ১৬০৯ সালে অ্যারিস্টটলিয়ান-টলেমি তত্ত্বের মৃত্যু ঘটে। সে বছরই গ্যালিলিও দুরবিনের মাধ্যমে রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেছিলেন। তখন সবেমাত্র দুরবিন আবিষ্কৃত হয়েছে।

সেবার বৃহস্পতি গ্রহের দিকে তাকিয়ে গ্যালিলিও দেখতে পেলেন, এ গ্রহটির চারপাশে বেশ কিছু ছোট ছোট উপগ্রহ বা চাঁদ ঘুরছে। এর মাধ্যমে সেবারই প্রথম প্রমাণিত হলো, আকাশের সব বস্তুই সরাসরি পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘোরে না। অথচ অ্যারিস্টটল ও টলেমি সে রকমই ধারণা করতেন। অবশ্য গ্যালিলিওর এ আবিষ্কারের পরও পৃথিবীই যে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে স্থির অবস্থায় রয়েছে, সে মতবাদটি বিশ্বাস করা সম্ভব ছিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তাহলে বৃহস্পতির চাঁদগুলোকে চরম জটিল কিছু কক্ষপথে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে হতো। তবে দেখে মনে হবে, সেগুলো বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে। বরং এই জটিলতার চেয়ে কোপার্নিকাসের তত্ত্বটি অনেক বেশি সরল ছিল।

প্রায় একই সময়ে কোপার্নিকাসের তত্ত্বটি রূপান্তর করেছিলেন কেপলার। এর মাধ্যমে তিনি প্রস্তাব করলেন, গ্রহেরা বৃত্তাকার পথে নয়, বরং উপবৃত্তাকার পথে ঘোরে। অবশেষে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে পর্যবেক্ষণও নিখুঁতভাবে মিলে গিয়েছিল। বিশেষ কিছু সুবিধার জন্য গ্রহের এই উপবৃত্তাকার কক্ষপথ স্রেফ সাময়িক হাইপোথিসিস হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন কেপলার। কিন্তু এই হাইপোথিসিসটি তাঁর অপছন্দের ছিল। কারণ তাঁর মতে, বৃত্তাকার কক্ষপথের চেয়ে উপবৃত্তাকার কক্ষপথ আসলে কম নিখুঁত। অনেকটা দুর্ঘটনাক্রমে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন যে উপবৃত্তাকার কক্ষপথ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে ভালোভাবে মিলে যায়। তাঁর ধারণা ছিল, গ্রহগুলো চুম্বকীয় বলের কারণে সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। কিন্তু নিজের এই ধারণার সঙ্গে উপবৃত্তাকার কক্ষপথের ধারণার কোনো সমন্বয় করতে পারেননি তিনি।

এ ঘটনার অনেক পরে এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়েছিল। সেটি ছিল ১৬৮৭ সাল। সে বছর প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা ন্যাচারালিস কজ শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন বিজ্ঞানী নিউটন। পদার্থবিজ্ঞানে এই বইটিই সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একক গবেষণাবিষয়ক প্রকাশনা। বইটিতে স্থান ও কালে বস্তুগুলো কীভাবে গতিশীল হয়, নিউটন শুধু সে তত্ত্ব প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হননি, একই সঙ্গে এসব গতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় গণিতও উন্নয়ন করেছিলেন তিনি। এসবের পাশাপাশি সার্বজনীন মহাকর্ষের একটি সূত্র প্রতিষ্ঠিত করেন নিউটন। এই সূত্রে বলা হয়েছিল, এই মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু একটি বল দিয়ে পরস্পরকে নিজেদের দিকে আকর্ষণ করছে। বস্তুগুলো যত বড় হবে এবং তারা পরস্পরের যত কাছে থাকবে, এই বল তত বেশি শক্তিশালী হবে। কোন বস্তুর ভূপৃষ্ঠে পড়ার পেছনের কারণও ওই একই বল। নিউটনের মাথায় একটি আপেল পড়ার যে গল্প চালু আছে, সেটির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ জাগাই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে নিউটনের নিজের ভাষ্য হচ্ছে, একবার ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তিনি বসে ছিলেন। ঠিক সে সময় একটি আপেল পড়তে দেখেছিলেন তিনি। ঠিক তখনই তাঁর মাথায় মহাকর্ষ সম্পর্কে চিন্তাটি এসেছিল।

নিউটন তাঁর সূত্রের সাহায্যে দেখালেন, মহাকর্ষের কারণেই পৃথিবীর চারদিকে চাঁদ উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে। আবার একই কারণে পৃথিবী ও অন্য গ্রহগুলো সূর্যের চারপাশে উপবৃত্তাকার পথ অনুসরণ করছে। অনেক আগেই টলেমির খ-গোলক বাতিল করেছিল কোপার্নিকাসের মডেল। একই সঙ্গে মহাবিশ্বের একটি প্রাকৃতিক সীমানা থাকার ধারণাও বাতিল করতে পেরেছিল তাঁর ওই মডেলটি। আপাতদৃষ্টিতে মনে করা হতো যে, সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে স্থির নক্ষত্রগুলো তাদের আপেক্ষিক অবস্থান পরিবর্তন করে না। তাই স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া হলো যে স্থির নক্ষত্রগুলো সূর্যের মতোই কোনো বস্তু, তবে সেগুলো আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। কিন্তু এতেও একটা সমস্যা দেখা দিল। নিউটন বুঝতে পারলেন, তাঁর মহাকর্ষ সূত্র অনুসারে এসব নক্ষত্রের পরস্পরকে আকর্ষণ করার কথা। কাজেই তারা কোনোভাবেই স্থির থাকতে পারে না। তাহলে কি কোনো একটা বিন্দুতে তাদের চুপসে বা ভেঙে পড়া উচিত নয়?

১৬৯১ সালে সেকালের আরেক শীর্ষস্থানীয় চিন্তাবিদ রিচার্ড বেন্টলির কাছে লেখা এক চিঠিতে এ বিষয়ে একটি যুক্তি দেখিয়েছেন নিউটন। চিঠিতে তিনি বলেছিলেন, ঘটনাটি কেবল তখনই সত্যি হতে পারে, যদি সেখানে একটি সসীম সংখ্যক নক্ষত্র থাকে। তিনি আরেকটি যুক্তিও দেখালেন। তিনি বললেন, সেখানে যদি অসীম স্থানে মোটামুটি সুষমভাবে অসীম সংখ্যক নক্ষত্র বিন্যস্ত থাকে, তাহলে তারা কোনো একটি বিন্দুতে ভেঙে পড়বে না। কারণ তাহলে তাদের ভেঙে পড়ার জন্য সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় বিন্দু থাকবে না। অসীমত্ব সম্পর্কে কোনো কথা বলতে গেলে চোরাগোপ্তা সমস্যার মুখে পড়তে হয়। এই যুক্তিটিও তেমনি একটি উদাহরণ।

একটি অসীম মহাবিশ্বের সব বিন্দুকেই কেন্দ্র হিসেবে ভেবে নেওয়া যায়। কারণ তাহলে প্রতিটি বিন্দুর সবদিকেই একটি অসীম সংখ্যক নক্ষত্র থাকবে। তাই এ ক্ষেত্রে সঠিক উপায়টি হচ্ছে, একটা সসীম পরিস্থিতি বিবেচনা করা, যেখানে সবগুলো নক্ষত্র পরস্পরের ওপর ভেঙে পড়বে। অবশ্য এ বিষয়টি বোঝা গিয়েছিল আরও অনেক পরে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে, এ অঞ্চলের বাইরে যদি মোটামুটি সুষমভাবে বিস্তৃত আরও নক্ষত্র যোগ করা হয়, তাহলে কী ঘটবে। নিউটনের সূত্রমতে, এসব অতিরিক্ত নক্ষত্র আগের নক্ষত্রগুলোর অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন করতে পারবে না। কাজেই নক্ষত্রগুলো আগের মতোই দ্রুতবেগে ভেঙে পড়তে থাকবে। আমরা যত খুশি নক্ষত্র যোগ করতে পারি, কিন্তু সেগুলো সব সময়ই তাদের নিজেদের ওপরই ভেঙে পড়তে থাকবে। এখন আমরা জানি, যেখানে মহাকর্ষ সব সময়ই আকর্ষণ করছে, সে রকম কোনো মহাবিশ্বের একটি অসীম স্থির মডেল থাকা অসম্ভব।

বিংশ শতকের আগে প্রচলিত চিন্তাভাবনার সাধারণ চিত্রটির সবচেয়ে চমকপ্রদ দিকটি হচ্ছে, সে সময় কেউই ধারণাই করতে পারেনি, এই মহাবিশ্ব প্রসারিত নাকি সংকুচিত হচ্ছে। তখন সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়েছিল, মহাবিশ্ব হয় অনন্তকাল ধরে অপরিবর্তনীয় অবস্থায় বিরাজমান অথবা একটি সসীম সময় আগের কোনো অতীতে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করা হয়েছিল, বর্তমানে যার খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। আবার মানুষের মধ্যে চিরন্তন কোনো সত্যে বিশ্বাসের প্রবণতাও ছিল সেকালে। তাই মানুষ একসময় বুড়ো হবে এবং মারাও যাবে, কিন্তু এই মহাবিশ্বের কোনো পরিবর্তন হবে না-এই চিন্তা করে কিছুটা স্বস্তি পেত তারা।

নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব প্রমাণ করে যে এই মহাবিশ্ব কখনোই স্থির অবস্থায় থাকতে পারে না। কিন্তু এই বিষয়টি যাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁরাও মহাবিশ্ব যে প্রসারিত হতে পারে, সেটি প্রস্তাব করার কথা কখনো চিন্তা করতে পারেননি। বরং তাঁরা ওই তত্ত্বকেই রূপান্তর করার চেষ্টা করলেন। এই তত্ত্বে অনেক বড় দূরত্বে মহাকর্ষীয় বলকে বিকর্ষী করে দেখালেন তাঁরা। অবশ্য তাতে গ্রহগুলোর গতির ক্ষেত্রে তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী তেমন একটা কাজে লাগেনি। তবে এর মাধ্যমে নক্ষত্রগুলোর একটি অসীম বণ্টনে ভারসাম্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা গিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে কাছের নক্ষত্রগুলোর আকর্ষী বল দূরের নক্ষত্রগুলোর বিকর্ষী বলের সঙ্গে কাটাকাটি বা বাতিল হয়ে ভারসাম্য রক্ষা করেছিল।

যা-ই হোক, আমরা এখন বিশ্বাস করি, এ ধরনের কোনো ভারসাম্য আসলে নড়বড়ে হতে বাধ্য। কোনো অঞ্চলে নক্ষত্রেরা যদি পরস্পরের সামান্য কাছে চলে আসে, তাহলে তাদের ভেতর আকর্ষণ বল অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং সেটি বিকর্ষণ বলের চেয়ে প্রবল হয়ে উঠবে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, তাতেও নক্ষত্রগুলো পরস্পরের ওপর আছড়ে বা ভেঙে পড়তে থাকবে। আবার অন্যদিকে নক্ষত্রগুলো যদি পরস্পরের কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরে যায়, তাহলে বিকর্ষণ বলটিই আকর্ষণ বলের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করবে। তাতেও তারা পরস্পর থেকে দূরে সরে যেতে থাকবে।

এছাড়া একটি অসীম স্থির মহাবিশ্বের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ আছে। এ জন্য সাধারণভাবে জার্মান দার্শনিক হেনরিক অলবার্সকে দায়ী করা হয়। সত্যি বলতে কি, নিউটনের সমসাময়িক অনেকেই এই সমস্যাটির কথা তুলেছিলেন। কিন্তু তারপরও অনেকের ধারণা, ১৮২৩ সালে অলবার্সের প্রকাশিত একটি নিবন্ধেই এ বিষয়ে প্রথম গ্রহণযোগ্য যুক্তি দেখানো হয়েছিল। কিন্তু সেটি সত্য নয়। আসলে এই নিবন্ধটিই প্রথম অনেকের নজরে পড়েছিল। সমস্যাটি হচ্ছে, একটি অসীম স্থির মহাবিশ্বে প্রায় সব রেখা বা পাশই একটি নক্ষত্রের পৃষ্ঠের ওপর এসে শেষ হবে। সে ক্ষেত্রে প্রত্যাশা করা যেতেই পারে যে, রাতের বেলায়ও পুরো আকাশ সূর্যের মতোই উজ্জ্বল হবে। অলবার্সের মতের বিপক্ষের যুক্তিটি ছিল, দূরের নক্ষত্র থেকে আসা আলো মধ্যবর্তী বাধা সৃষ্টিকারী বস্তুসমূহ শোষণ করে নেওয়ার কারণে তা অনুজ্জ্বল হয়ে যাবে। তা-ই যদি হয়, তাহলে বাধা দেওয়া বস্তুগুলো ক্রমান্বয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠবে এবং একসময় তারা নক্ষত্রের মতোই উজ্জ্বল আলো ছড়াতে শুরু করবে।

রাতের পুরো আকাশও সূর্যপৃষ্ঠের মতো উজ্জ্বল হবে-এই উপসংহার এড়ানোর একটিমাত্র উপায় আছে। উপায়টি হচ্ছে, যদি ধরে নেওয়া হয় যে নক্ষত্রগুলো অনন্তকাল আলো ছড়াচ্ছে না, বরং অতীতের কোনো সসীম সময়ে তারা জ্বলতে শুরু করেছিল। তাহলে এ ক্ষেত্রে আলো শোষণকারী বস্তুগুলো হয়তো আর উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারেনি কিংবা দূরবর্তী নক্ষত্রগুলো থেকে আলো হয়তো আমাদের কাছে এসে আর পৌঁছাতে পারেনি। কিন্তু তাতে আমাদের আরেকটি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়-তাহলে শুরুতে ওই নক্ষত্রগুলো কী কারণে জ্বলতে শুরু করেছিল?

মহাবিশ্বের সূচনা
কোন সন্দেহ নেই অনেক দিন ধরেই এই মহাবিশ্বের সূচনা বিষয়ক আলোচনা শুরু হয়েছে। ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলিম ঐতিহ্যের প্রাথমিক বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব মোতাবেক, সসীম কোন কালে এই মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল। আর অতীতের সেই সময়টি খুব বেশিদিন আগের নয়। এই মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ব্যাখ্যার জন্য একটি আদি কারণ থাকা জরুরি-এই অনুভূতিই এ ধরনের সূচনার সপক্ষে একটি যুক্তি।

এর সপক্ষে আরেকটি যুক্তি পেশ করেছিলেন সেন্ট অগাস্টিন তাঁর দ্য সিটি অব গড বইটিতে। তিনি ইঙ্গিত করেছিলেন, মানবসভ্যতা অগ্রসর হচ্ছে এবং এই কাজটি কে করেছিলেন কিংবা এই কৌশল কে বিকশিত করেছিলেন, তাকে আমরা স্মরণ করি। কাজেই মানুষ ও একই সঙ্গে সম্ভবত এই মহাবিশ্ব খুব বেশি সময় আগে সৃষ্টি হয়নি। কারণ তাই যদি হতো তাহলে, আমরা এরই মধ্যে বর্তমানের চেয়ে আরও অনেক বেশি উন্নতি করতে পারতাম।

বাইবেলের বুক অব জেনেসিস বা সৃষ্টিতত্ত্ব অনুসারে, এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির বয়স খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় পাঁচ হাজার বছর বলে মেনে নিয়েছিলেন সেন্ট অগাস্টিন। মজার ব্যাপারটি হচ্ছে, এটি প্রায় ১০ হাজার বছর আগের সর্বশেষ তুষারযুগের চেয়ে খুব বেশি দূরে নয়। আসলে এই সময়টাতেই সভ্যতার সূচনা হয়েছিল। অন্যদিকে অ্যারিস্টটল আর অধিকাংশ গ্রিক দার্শনিক বিশ্ব সৃষ্টির এই ধারণাটি পছন্দ করতেন না। কারণ তাঁদের মতে, এতে স্বর্গীয় হস্তক্ষেপের পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে যায়। বরং তাঁরা বিশ্বাস করতেন, অনেক আগে থেকেই মানবজাতি ও পারিপার্শ্বিক বিশ্বের অস্তিত্ব ছিল এবং অনন্তকাল এর অস্তিত্ব থাকবে। আবার সভ্যতার বিকাশ নিয়ে আগে উল্লেখ করা যুক্তিটি সম্পর্কেও চিন্তাভাবনা করেছিলেন তাঁরা। এর জবাব হিসেবে তাঁদের পাল্টা যুক্তিটি ছিল, অতীতে বিভিন্ন পর্যায়ে বন্যা বা অন্য ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানবজাতিকে বারবার সভ্যতার শুরুর দিকে অর্থাত্ পেছন দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
তখন অনিবার্যভাবে অধিকাংশ মানুষ স্থির ও অপরিবর্তনীয় মহাবিশ্ব মতবাদে বিশ্বাস করত। কাজেই সে সময় মহাবিশ্বের শুরু আছে কি নেই, সেই প্রশ্নটি আসলে অধিবিদ্যা বা ধর্মবিশ্বাসের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এতকাল ধরে যা কিছু পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে তা নিয়ে দুদিক থেকেই যুক্তি দেখানো যায়। একদিকে মহাবিশ্বের অস্তিত্ব চিরকাল ছিল কিংবা অতীতের সসীম কোনো এক সময়ে এর সূচনা হয়েছিল। আর এই সূচনাটি এমনভাবে হয়েছিল, যেন তাকে চিরকাল অস্তিত্বশীল বলে মনে হবে। তবে ১৯২৯ সালে বৈপ্লবিক এক পর্যবেক্ষণ করেছিলেন এডউইন হাবল। এ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সেবার তিনি প্রমাণ করলেন, যেখান থেকেই দেখা হোক না কেন, দেখা যাবে যে দূরের নক্ষত্রগুলো আমাদের কাছ থেকে অনেক দ্রুত বেগে সরে যাচ্ছে। এর সরল অর্থ, এই মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। অর্থাত্ অতীতের কোনো এক সময়ে এই মহাবিশ্বের সব বস্তু একসঙ্গে বা খুব কাছাকাছি ছিল। আসলে এটি দেখে মনে হয়, প্রায় ১০ বা ২০ হাজার মিলিয়ন বছর আগে সবকিছুই একটা জায়গায় পুঞ্জিভূত ছিল।

তাঁর এই আবিষ্কার অবশেষে মহাবিশ্বের সূচনা বিষয়ক প্রশ্নটি বিজ্ঞানের রাজ্যে টেনে এসেছিল। হাবলের পর্যবেক্ষণগুলো ইঙ্গিত দেয়, মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং নামের কোন একটি সময়ের অস্তিত্ব ছিল। এই সময়টিতে মহাবিশ্ব অসীমভাবে ক্ষুদ্র আকারের ছিল। সে কারণেই মহাবিশ্ব অসীমভাবে ঘনীভূতও ছিল। এই ঘটনার আগে যদি কোনো সময়ের অস্তিত্ব থাকে তাহলে সেটি বর্তমান সময়ের ঘটনাকে প্রভাবিত করতে পারবে না। তাই তাদের অস্তিত্বকে উপেক্ষা করা যায়। কারণ তাদের পর্যবেক্ষণগত কোনো ফলাফল নেই।

বলা যেতে পারে, বিগব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমেই সময়ের শুরু হয়েছিল। কথাটি এই অর্থে বলা যায় যে মহাবিস্ফোরণের আগের সময় সহজভাবে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না। তাই বেশ জোর দিয়েই বলা উচিত, সময়ের এই শুরুটা তার আগের আলোচিত সময় থেকে একেবারেই আলাদা। একটি অপরিবর্তনীয় মহাবিশ্বে, সময়ের শুরুর ঘটনা এমন একটা কিছু, যা মহাবিশ্বের বাইরের কাউকে চাপিয়ে দিতে হবে। একটা সূচনা বা শুরুর জন্য এমন কোনো ভৌত বিষয় জরুরী নয়। অনেকে কল্পনা করে নিতে পারে, আক্ষরিক অর্থেই এই মহাবিশ্ব অতীতের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঈশ্বর সৃষ্টি করেছিলেন। আবার মহাবিশ্ব যদি প্রসারিত হতে থাকে, তাহলে এর একটি শুরুর পেছনে ভৌত কারণও থাকতে পারে। তারপরও অনেকে বিশ্বাস করতে পারে, মহাবিস্ফোরণের সময়েই ঈশ্বর মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। আবার এমনকি তিনি পরের কোনো সময়েই এটি এমনভাবে সৃষ্টি করে থাকতে পারেন যে যা দেখে মনে হবে মহাবিশ্বের একটি মহাবিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটেছিল। তবে মহাবিস্ফোরণের আগে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল এটি ধরে নেওয়া অর্থহীন হতে পারে। একটি প্রসারণশীল মহাবিশ্ব কোনো সৃষ্টিকর্তাকে বাতিল করে না। তবে তিনি কাজটি কখন করবেন সে বিষয়ে একটি নিদিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়।

অনুবাদ: আবুল বাসার