এখনো উন্নত বুদ্ধিমত্তার স্তরে উঠতে পারেনি সোফিয়া

রোবট সোফিয়া
রোবট সোফিয়া

রোবট সোফিয়ার কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকা মাতিয়ে গেছে হংকংভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হ্যানসন রোবটিকসের তৈরি করা আলোচিত এ রোবট। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন নারীর অবয়বে গড়া এই রোবট নিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে হংকংয়ের প্রতিষ্ঠানটি। তারা কি ‘পুতুল’ দেখিয়ে মানুষ ঠকাচ্ছে, নাকি সত্যিই এর মধ্যে আছে প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা? সোফিয়ার বুদ্ধিমত্তা এখনো উন্নত পর্যায়ে যায়নি বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোফিয়া জীবিত কিছু নয়, তা জেনেবুঝেও নানা কৌশলে সোফিয়ার বিপণন করে যাচ্ছে হ্যানসন রোবোটিকস। কিন্তু আসলে সোফিয়ার মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নতি কতটুকু?

সিএনবিসি বলছে, সোফিয়া রোবট এখন সাংস্কৃতিক প্রতীকে পরিণত হয়েছে। স্টেজ শো থেকে শুরু করে বিভিন্ন ম্যাগাজিনের কভার পাতায় জায়গা করে নিয়েছে সোফিয়া। বড় বড় প্রযুক্তি সম্মেলনের আকর্ষণ সোফিয়া। জাতিসংঘে ভাষণ পর্যন্ত দিয়েছে সোফিয়া। সোফিয়াকে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ হিসেবে বিবেচনা হচ্ছে। কিন্তু এটি কতটুকু জনসংযোগের কৌশল আর সামাজিক পরীক্ষার কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা, তা বিবেচনার দাবি রাখে।

ফোর্বস অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সোফিয়াকে সৌদি আরবের নাগরিকত্ব দেওয়ার পর এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়। রিয়াদে প্রদর্শনের সময় রোবটটির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ভিজুয়াল ডেটা প্রসেসিং ও ফেসিয়াল রিকগনিশন পদ্ধতিতে কাজ করে রোবটটি। ২০১৫ সালের ১৯ এপ্রিল সোফিয়াকে চালু করা হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে সোফিয়া। ইতিমধ্যেই সে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় গণমাধ্যমকর্মীদের মুখোমুখি হয়ে প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, উপযুক্ত পরিস্থিতিতে সে হাসতে পারে, এমনকি কৌতুকও বলতে পারে।

কিন্তু সোফিয়াকে বুঝতে হলে আরও কিছু জানা জরুরি। যেমন এর পেছনে কে? এর পেছনে রয়েছেন ডেভিড হ্যানসনকে। তিনি হ্যানসন রোবটিকসের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ায় তাঁকে বড় কেউ বলে মনে করা হয় না।

যুক্তরাষ্ট্রের রোড আইল্যান্ড স্কুল অব ডিজাইন থেকে ফাইন আর্টসে স্নাতক করেন হ্যানসন। এরপর ওয়াল্ট ডিজনিতে ইমাজিনিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বিভিন্ন থিমপার্কের জন্য নানা ভাস্কর্য ও রোবটপ্রযুক্তি তৈরি করার কাজ করেন। পরে তিনি ইন্টারঅ্যাকটিভ আর্টস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তাঁর ক্যারিয়ারের লক্ষ্য হলো মানুষসদৃশ রোবট তৈরি করা। ২০০৫ সালে একটি গবেষণাপত্রের সহলেখক ছিলেন, তিনি যাতে রোবটিকসের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর লক্ষ্যের কথা বলা হয়। বর্তমানে সোফিয়াকে নিয়ে যা হচ্ছে, তার সঙ্গে ওই গবেষণাপত্রের কিছুটা মিল রয়েছে।

আট পাতার ওই গবেষণাপত্রকে বলা হয় ‘আপেন্ডিং দ্য আনক্যানি ভ্যালি’। এটি মূলত আনক্যানি ভ্যালি তত্ত্বের প্রতি হ্যানসনের তিরস্কার। ওই তত্ত্ব অনুযায়ী, মানবসদৃশ কিন্তু পুরো মানুষ নয়, এমন রোবট পছন্দ করবে না কেউ, কারণ এটি দেখতে অপার্থিব এবং মানুষের মনে জিনিসটির প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরি করে। হ্যানসন এর বিরোধিতা করে বলেন বরং অপার্থিবতাই রোবটকে বোঝার জন্য সুবিধা হবে। তাই মানুষসদৃশ রোবট নিয়ে পরীক্ষা চালাতে ভয়ের কিছু নেই।

ডেভিড হ্যানসন বলেছেন, ‘সোফিয়া সামাজিক একটি রোবট। যাকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যে সে মানুষের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। যেকোনো মানুষের আচরণও শিখতে পারে। তাই তাকে তৈরি করতে আমাদের প্রয়োজন হয় বুদ্ধিদীপ্ত মেশিন। আমরা তাকে আমাদের সঙ্গে রাখতে চাই। এখন সে আমাদের কাছে শিশুর মতো। ধীরে ধীরে পৃথিবীতে সে ছড়িয়ে পড়বে। সে মানুষকে ভালোবাসতে এবং শিক্ষা দিতে পারবে। সে মানুষের স্বপ্নের কথা উপলব্ধি করতে পারবে এবং সে ভবিষ্যতে উন্নত পৃথিবীর জন্য কাজ করবে। আসলে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে অনেক কিছু জানতে পারবে। সময়ের সঙ্গে তাঁর ধারণারও পরিবর্তন আসবে।’

হ্যানসন আরও বলেছেন, মানুষসদৃশ রোবট উন্নত করতে বৈজ্ঞানিক ও শৈল্পিক—দুই ধারণা নিয়েই কাজ করছে তার প্রতিষ্ঠান। সোফিয়ার মতো রোবটে সেই পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। তিনি একটি ধারণাগত পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর সেই ধারণা অনুযায়ী, সোফিয়া এখনো শিশু পর্যায়ে রয়েছে। এর পরের ধাপ হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইনটেলিজেন্স বা এজিআই। কিন্তু এখনো মানুষের পক্ষে তা অর্জন করা সম্ভব হয়নি।
হ্যানসন মনে করেন, এজিআই স্তরে পৌঁছাতে গেলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্মাতাদের অভিভাবক বা মা-বাবার মতো করে ভাবতে হবে। তিনি বলেন, ‘এজিআইকে ভালো সন্তানের মতো করে বড় করতে হবে। শিকলে বাঁধা কোনো কিছুর মতো করে নয়।’ তাঁর মতে, নিরাপদ সুপার ইন্টেলিজেন্সের খোঁজ করার সূত্র এটাই।

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে প্রযুক্তিবিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পেছনে ছুটছে। সবার লক্ষ্য সুপার ইন্টেলিজেন্স অর্জন করা। বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই সুপার ইন্টেলিজেন্স স্তরে পৌঁছানোর জন্য চেষ্টা করছেন। সোফিয়া কি সে স্তরে যেতে পেরেছে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইনটেলিজেন্স (এজিআই) বিবেচনায় ধরলে সোফিয়া এখনো সেই স্তরে যেতে পারেনি।

হ্যানসন রোবোটিকসের প্রধান বৈজ্ঞানিক বেন গোয়ের্তজেল বলেন, ‘সফটওয়্যারের দৃষ্টিকোণ থেকে সোফিয়াকে একটি প্ল্যাটফর্ম বলা যায়। কোনো কাজ করার জন্য ল্যাপটপ যেমন একটি প্ল্যাটফর্ম, ঠিক তেমনই প্ল্যাটফর্ম সোফিয়া। বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার প্রোগ্রাম একই রোবটের মধ্যে চালানো যায়।’

সোফিয়াতে তিনটি ভিন্ন ধরনের কন্ট্রোল সিস্টেমস রয়েছে। একটি হচ্ছে ‘টাইমলাইন এডিটর’। অন্য দুটি হচ্ছে ‘সফিসটিকেটেড চ্যাট সিস্টেম’ ও ‘ওপেনকগ’। এর মধ্যে টাইমলাইন এডিটর বিষয়টি হচ্ছে সরাসরি স্ক্রিপ্টিং সফটওয়্যার। এতে যা কিছু স্ক্রিপ্ট করে দেওয়া হবে, সোফিয়া তা-ই করবে। সফিসটিকেটেড চ্যাট সিস্টেমের মাধ্যমে সোফিয়া বিভিন্ন শব্দ বাছাই করে তা থেকে কথোপকথন চালাতে পারে। ওপেনকগ হচ্ছে বিভিন্ন বিষয়ে সোফিয়ার অভিজ্ঞতা ও অর্জন করা বুদ্ধি। এই সিস্টেমটি ব্যবহার করে একদিন এজিআই তৈরির আশা করছে হ্যানসন রোবটিকসের কর্তৃপক্ষ।

হ্যানসন রোবটিকসের লোকদেখানো ‘পুতুল’-এর সমালোচকেরও অভাব নেই। ফেসবুকের এআই বিভাগের প্রধান ইয়ান লিকুন সোফিয়া রোবটকে বিশেষ ‘পুতুল’ বলে বর্ণনা করেছেন। ফেসবুকে লেখা এক পোস্টে লিকুন জানান, হ্যানসনের কর্মীরা পুতুলনাচ দেখিয়ে জনসমক্ষে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছেন।

আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইনটেলিজেন্স বা এজিআই আরও কয়েকটি নামে পরিচিত। একে কেউ বলেন গ্র্যান্ড স্কিম অব থিংস, সেন্টিনেন্ট বিং। তবে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমান যন্ত্র তৈরির লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে হোন্ডা থেকে শুরু করে বোস্টন ডায়নামিকসের মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু এখনো চূড়ান্ত পর্যায়ে কেউ যেতে পারেনি। সবার আগে কে এজিআই তৈরি করতে পারে, তা নিয়েই প্রতিযোগিতা চলছে।

কিন্তু এ ধরনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও তার ব্যবহার নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও সচেতনতা বাড়ছে। এ বছরের শুরুতে ফেসবুকের ‘কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা’ কেলেঙ্কারির পর মানুষ এখন বেশি সচেতন। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা নামের একটি নির্বাচনী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ফেসবুক থেকে তথ্য নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে লাগায় বলে এটি এ নামে পরিচিতি পায়।

সিএনবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিতে ‘দ্রুত এগিয়ে যাও এবং সবকিছু গুঁড়িয়ে দাও’ মন্ত্রে ছুটে চলছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নির্মাতারা। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে তাই নৈতিকতার প্রশ্ন উঠছে। অনেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরির সময় দায়িত্বশীল হতে বলেছে। কারণ, প্রযুক্তি ও রোবোটিকস এখন আর গবেষণা কেন্দ্রে বা কোনো স্টার্ট আপে সীমাবদ্ধ নেই। প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে নৈতিকতার শর্তগুলো রাখার পক্ষে যুক্তরাজ্যের মনফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্যাথলিন রিচার্ডসন। তিনি বলেন, ‘প্রকৌশল, রোবোটিকস ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে এবং তৈরিতে কল্পনা কাজ করে। মানুষের কাজে লাগবে, এমন প্রযুক্তি নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ অনেকেই নিজেকে সৃষ্টিকর্তা ভাবছে।’