আমাদের লিনাক্সচর্চা

লিনাক্সচর্চা
লিনাক্সচর্চা

কম্পিউটারের বিভিন্ন হার্ডওয়্যার বা যন্ত্রাংশকে যদি দেহের সঙ্গে তুলনা করি, তবে অপারেটিং সিস্টেম হচ্ছে এর প্রাণ। অপারেটিং সিস্টেমের কাজ হচ্ছে কম্পিউটারকে চালানো। আমাদের দেশের বেশির ভাগ কম্পিউটারেই অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে আছে উইন্ডোজ। তবে ব্যবহারকারীদের অনেকেই লিনাক্স শব্দটি কখনো না-কখনো শুনে থাকবেন। লিনাক্সও হচ্ছে একটি অপারেটিং সিস্টেম, যা দিয়ে কম্পিউটার চালানো যায়। তবে শুধু কম্পিউটার নয়, অনেকে যে অ্যান্ড্রয়েড-চালিত মোবাইল ফোন ব্যবহার করে থাকেন, সেটিও একধরনের লিনাক্স। শুরুতে মেইনফ্রেম কম্পিউটার ও সার্ভারে লিনাক্সের ব্যবহার চালু হলেও ধীরে ধীরে ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, নোটবুক, মোবাইল ও নানান ধরনের যন্ত্রের প্রাণ এনে দেওয়ার কাজে লিনাক্স জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমটি তৈরি করেন ফিনল্যান্ডের নাগরিক লিনাস টরভাল্ডস, ২৩ বছর আগে, ১৯৯১ সালে। তার আগে ইউনিক্স অপারেটিং সিস্টেম চালু থাকলেও সেটির প্রোগ্রামিং সংকেত বা সোর্স কোড উন্মুক্ত ছিল না। লিনাক্সের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি ওপেন সোর্স, অর্থাৎ এর সোর্স কোড উন্মুক্ত। যে কেউ এই সোর্স কোড নামিয়ে নিতে পারবে, নিজের দরকার অনুসারে এর কোনো অংশ পরিবর্তন করতে পারবে (এর জন্য অবশ্যই প্রোগ্রামিং জানতে হবে)। আবার সেই পরিবর্তিত সোর্স কোড বিতরণও করতে পারবে। তাই লিনাসের তৈরি লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমের রয়েছে অসংখ্য ডিস্ট্রিবিউশন—যেমন: আর্চ লিনাক্স, ডেবিয়ান, ফেডোরা, উবুন্টু, লিনাক্স মিন্ট, সেন্ট ওএস, ওপেন সুসে ইত্যাদি। এগুলোর একেকটি দেখতে একেক রকম হলেও মূলে রয়েছে লিনাক্সের কার্নেল, মানে লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমের মূল অংশ। লিনাক্স কার্নেলের ওপর ভিত্তি করে আরও প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার তৈরি করে সেই ডিস্ট্রিবিউশনগুলো সাজানো হয়।

লিনাস টরভাল্ডস
লিনাস টরভাল্ডস

একসময় লিনাক্সে কোনো গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস (সংক্ষেপে গুই) ছিল না। মানে ছবিতে ক্লিক করে কোনো নির্দেশ দেওয়া যেত না। তখন কমান্ড লাইনেই বিভিন্ন নির্দেশ লিখে দিয়ে কাজ করতে হতো। যে কারণে সাধারণ ব্যবহারকারীরা তাঁদের ডেস্কটপে উইন্ডোজই ব্যবহার করতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে সে চিত্র পাল্টাতে থাকে, বিশেষ করে গত এক দশকে অনেকখানি সহজ হয়ে উঠেছে লিনাক্স। এখনকার দিনের বিভিন্ন লিনাক্স ডিস্ট্রিবিউশনে রয়েছে চমৎকার গুই (গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস)। ফলে সাধারণ বা দৈনন্দিন কাজগুলো করতে আর কমান্ড লেখার প্রয়োজন হয় না। লিনাক্সের গুই উইন্ডোজের মতোই সহজ।
বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কয়েকটি ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (আইএসপি) চালু হয়। সেগুলোর প্রতিটিই লিনাক্সের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বিডিকম অনলাইন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুমন আহমেদ বললেন, ‘সেই সময় আমরা কার্নেল ১.০-এ কাজ শুরু করি। শেখার জন্য কিছু বই আর ডকুমেন্টেশন ছিল, সেগুলো ঘেঁটে ঘেঁটেই আমাদের শেখা। সার্ভারের কাজের জন্য ইউনিক্সই তখন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ছিল, কিন্তু ওগুলোর দাম ছিল অনেক বেশি, তাই আমাদের জন্য লিনাক্স ব্যবহারের কোনো বিকল্প ছিল না।’ বর্তমানেও বাংলাদেশের আইএসপিগুলোর প্রথম পছন্দ লিনাক্স। তবে এখন কাজ অনেক সহজে করা যায়। আগে যেই কাজ করতে হয়তো তিন-চার দিন চলে যেত, সেই কাজ এখন তিন-চার ঘণ্টায় করে ফেলা যায়। আর ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার জন্য নতুন কিছু শিখে নিতে তেমন বেগ পেতে হয় না।
১৯৯৯ সালে তৈরি হয় বিডিলাগ (বাংলাদেশ লিনাক্স ইউজার গ্রুপ)। একটি ইয়াহু গ্রুপের মাধ্যমে সেখানে সদস্যরা একে অপরকে সাহায্য করতেন। তারপর নতুন সহস্রাব্দের শুরুর দিকে আরও কিছু সংস্থা বাংলাদেশে লিনাক্সভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অঙ্কুর। লিনাক্সের বাংলা অনুবাদের (লোকালাইজেশন) কাজটি তারা করে বেশ ভালোভাবেই। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক গঠিত হলে লোকালাইজেশনের কাজে বেশ গতি আসে। ওপেন সোর্সকে জনপ্রিয় করে তুলতে দেশের অনেকগুলো এই নেটওয়ার্ক গঠিত হয়। তাদের অন্যতম কাজ ছিল ওপেন সোর্সকে জনপ্রিয় করা আর সেটি করতে গেলে লিনাক্স ব্যবহারের বিষয়টিই চলে আসে সবার আগে। তবে উইন্ডোজেও কিন্তু অনেক ওপেন সোর্স সফটওয়্যার ব্যবহার করা যায়।
একজন সাধারণ ব্যবহারকারী কেন লিনাক্স ব্যবহার করবেন? প্রথম কথা হচ্ছে, এর ব্যবহার উইন্ডোজের মতোই সহজ, বাড়তি কোনো জটিলতা নেই। আর এটি টাকা দিয়ে কিনতে হয় না। উইন্ডোজ কিন্তু টাকা দিয়ে কিনতে হয়; কপি করে উইন্ডোজ ব্যবহার, তাদের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট অনুমোদন করে না। আমরা সাধারণত কম্পিউটার দিয়ে কী কী কাজ করি? ইন্টারনেট ব্যবহার, লেখালেখি, হিসাব-নিকাশ, উপস্থাপনা তৈরি, বার্তা পাঠানোর সফটওয়্যারই মূলত ব্যবহার করি। আর বিনোদনের জন্য গান শুনি, ভিডিও দেখি আর গেম খেলি। এসব কাজের জন্যই কিন্তু ওপেন সোর্স সফটওয়্যার রয়েছে, যেগুলো লিনাক্সে ব্যবহার করা হয়। আর সেসব বিনা মূল্যেই পাওয়া যায়। কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা সবচেয়ে বেশি ভোগেন ভাইরাসের আক্রমণ নিয়ে। লিনাক্সে এই সমস্যাগুলো নেই। বিষয়টি এমন না যে লিনাক্সে ভাইরাস বানানো অসম্ভব, বাস্তবে লিনাক্সের জন্য খুব কম মানুষই ভাইরাস তৈরির চেষ্টা করে। তাই সব লিনাক্স ব্যবহারকারীই বছরের পর বছর নিশ্চিন্তে তার কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারেন। আরেকটি সুবিধা হচ্ছে, লিনাক্স ডিস্ট্রিবিউশনগুলো নিয়মিত হালনাগাদ হয়। যদি ইন্টারনেট-সংযোগ থাকে, তাহলে আপনি আপনার লিনাক্সকে সব সময়ই হালনাগাদ করে রাখতে পারবেন। বর্তমানের সব কম্পিউটার-সংশ্লিষ্ট যন্ত্র (যেমন: প্রিন্টার, স্ক্যানার, ওয়েবক্যাম ইত্যাদি) লিনাক্সে ব্যবহার করা যায়, কোনো ঝামেলা ছাড়াই। এত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও লিনাক্সের ব্যবহার কম৷ কারণ হচ্ছে, বেশির ভাগ মানুষই লিনাক্স সম্পর্কে জানে না।
বাংলাদেশে সাধারণ কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের কাছে লিনাক্স এখনো জনপ্রিয় না হলেও সফটওয়্যার প্রোগ্রামারদের অনেকেই কিন্তু লিনাক্স ব্যবহার করেন। সি, সি++, জাভা, পার্ল, পাইথন, পিএচইচপ, রুবি ইত্যাদি ওপেন সোর্স প্রোগ্রামিং ভাষায় কাজ করার জন্য লিনাক্স হচ্ছে আদর্শ অপারেটিং সিস্টেম। একলিপস, নেটবিনসের মতো বড় আইডিইগুলো লিনাক্সে চলে ভালোমতোই। এ ছাড়া ওয়েবসাইট ডিজাইন বা ওয়েবভিত্তিক প্রোগ্রাম তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার যেমন: অ্যাপাচি বা ইঞ্জিনএক্স ওয়েব সার্ভার, ডেটাবে সার্ভার, বিভিন্ন টুল, প্যাকেজ খুব সহজেই লিনাক্সে ইনস্টল করা যায়। যেহেতু পৃথিবীর বেশির ভাগ সার্ভার লিনাক্সে চলে, তাই ওয়েব নির্মাতাদের কাজ করার জন্য প্রথম পছন্দই হচ্ছে লিনাক্সভিত্তিক কোনো একটি অপারেটিং সিস্টেম।
খুব নিকট ভবিষ্যতে যখন আমাদের দেশে লাইসেন্স ছাড়া কোনো সফটওয়্যার ব্যবহার করা পুরোপুরি নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, তখন কেবল সরকারি অফিসের কম্পিউটারে অপারেটিং সিস্টেম ও অফিস প্যাকেজের লাইসেন্স কিনতে গিয়েই কোটি কোটি টাকা দেশ থেকে বের হয়ে যাবে। তাই এখনই উচিত এগিয়ে আসা এবং সরকারিভাবে লিনাক্সের একটি ডিস্ট্রিবিউশন তৈরি করে ফেলা। কাজটি মোটেও কঠিন কিছু নয় এবং আমাদের দেশের প্রোগ্রামাররাই এটি খুব ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারবেন।

টাক্স নামের পেঙ্গুইনটি লিনাক্সের প্রতীক
টাক্স নামের পেঙ্গুইনটি লিনাক্সের প্রতীক

বিভিন্ন ওপেন সোর্স সফটওয়্যার
ওয়েবসাইট দেখার সফটওয়্যার: মজিলা ফায়ারফক্স, গুগল ক্রোম
লেখালেখির জন্য: লিব্রা অফিস রাইটার
স্প্রেডশিট: লিব্রা অফিস ক্যাল্ক
মাল্টিমিডিয়া উপস্থাপনা: লিব্রা অফিস ইমপ্রেস
ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং: পিজিন
ছবি সম্পাদনা: গিম্প
ভিডিও প্লেয়ার: ভিএলসি
লেখক: প্রোগ্রামার