বিপর্যয়েও নিরাপদ থাকবে বীজ

পাহাড় কেটে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৮ লাখ ৪০ হাজার প্রজাতির শস্যবীজ
পাহাড় কেটে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৮ লাখ ৪০ হাজার প্রজাতির শস্যবীজ

পাহাড়ের ভেতর সংরক্ষণাগার। সেখানে রাখা হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের বীজ। এই বীজ অক্ষত থাকবে শতাব্দীর পর শতাব্দী। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট—কোনো বিপর্যয়ই সেগুলো নষ্ট করতে পারবে না।
নরওয়ের উত্তর মেরু এলাকার দ্বীপপুঞ্জ এসভালবার্ডে অবস্থিত একটি পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে সংরক্ষণাগারটি। এসভালবার্ড গ্লোবাল সিড ভল্ট নামের এ সংরক্ষণাগারটি ২০০৮ সালে উদ্বোধন করা হয়। তবে এত দিন সেখানে কেবল বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশস্যের বীজ রাখা হচ্ছিল। এবার নেওয়া হয়েছে বনজ উদ্ভিদের বীজ সংরক্ষণের উদ্যোগ। বিভিন্ন জাতের বনজ উদ্ভিদের বীজের প্রথম চালান এরই মধ্যে সেখানে পৌঁছে গেছে।
প্রথম চালানে নরওয়ে স্প্রাস এবং স্কট পাইনগাছের বীজের নমুনা সংরক্ষণাগারে রাখা হয়েছে। গবেষকেরা আশা করছেন, এ নমুনাগুলো বিশ্বের প্রাকৃতিক বনের উদ্ভিদের দীর্ঘমেয়াদি জিনগত পরিবর্তনের ওপর নজর রাখতে সাহায্য করবে।
বীজ সংরক্ষণাগারটি তৈরি করা হয়েছে স্পিটসবারজেন দ্বীপের একটি বেলেপাথরের পাহাড়ের ১২০ মিটার গভীরে। সেখানে রয়েছে জোরালো নিরাপত্তাব্যবস্থা। বীজগুলো চার ভাঁজের একধরনের বিশেষ প্যাকেটে রাখা হয়। এতে করে আর্দ্রতা ঢুকতে পারে না।
এ ধরনের সংরক্ষণাগারের জন্য স্পিটসবারজেন দ্বীপকে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করার অন্তত দুটি কারণ রয়েছে। একটি হচ্ছে এখানে ভূমির অভ্যন্তরীণ গঠনমূলক ক্রিয়াকলাপ (টেকটোনিক অ্যাক্টিভিটি) অনুপস্থিত। দ্বিতীয়টি হচ্ছে বরফাচ্ছাদিত অঞ্চল (পার্মাফ্রস্ট)। স্থানটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। ফলে বরফের পৃষ্ঠভাগ গলে গেলেও সংরক্ষণাগারটি শুষ্ক থাকবে। আর স্থানীয়ভাবে খনি থেকে উত্তোলিত কয়লা থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে শীতলীকরণ যন্ত্রগুলো চলে। এগুলো বীজগুলোর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে আদর্শ মানের তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামানোর ব্যবস্থা করে দেয়।
সংরক্ষণাগারটির জন্য বীজ সংগ্রহের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি ন্যাচারাল রিসোর্স ইনস্টিটিউট ফিনল্যান্ড। প্রতিষ্ঠানটির গবেষক মারি রুসানেন বলেন, এ উদ্যোগের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু গাছের বর্তমান জিনগত গঠনকে দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণ করা যাবে। মানবসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয় এগুলোকে ক্ষতি করতে পারবে না।
স্কট পাইন (pinus sylvenstris) ও নরওয়ে স্প্রাসের (picea abies) এই নমুনা বীজগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে ফিনল্যান্ড ও নরওয়ের বিভিন্ন প্রাকৃতিক বন থেকে। উত্তর ইউরোপ ও উত্তর আটলান্টিকের বিভিন্ন এলাকা নিয়ে গঠিত নর্ডিক দেশগুলোর বেশ কিছু সংস্থার একটি সংঘ এই প্রথম চালানের বীজগুলো সরবরাহ করেছে। প্রথম চালানে ওই দুটি প্রজাতি বেছে নেওয়ার কারণ হচ্ছে, তারা অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে থাকে।
এসভালবার্ড গ্লোবাল সিড ভল্ট পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ক্রপ ডাইভার্সিটি ট্রাস্টের (জিসিডিটি) কর্মকর্তা ব্রায়ান লেইনফ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, হিমায়িত ওই সংরক্ষণাগারে বনজ গাছের বীজ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘বনজ গাছের প্রজাতিগুলোর জিনগত বৈচিত্র্য অনেকগুলো কারণে প্রভাবিত হয়। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন ও বন ব্যবস্থাপনা-সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড বনজ গাছের প্রজাতিগুলোর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
এসভালবার্ড ভল্টে নতুন আসা অন্যান্য বীজের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দপ্তর থেকে পাঠানো সয়াবিন, যব, মসুর, জোয়ার (ভুট্টাজতীয় খাদ্যশস্য) ও গম এবং আফ্রিকা মহাদেশের ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান আফ্রিকা রাইস থেকে পাঠানো প্রায় আড়াই হাজার ধানবীজের নমুনা।
নরওয়ের মূল ভূখণ্ড ও উত্তর মেরুর মাঝামাঝি এলাকায় অবস্থিত ওই সংরক্ষণাগারটি গড়ে তুলতে সাড়ে সাত মিলিয়ন মার্কিন ডলার ও এক বছর সময় লেগেছে। এখানে বিশ্বের খাদ্যশস্যগুলো স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা আছে বলে দাবি এর পরিচালনাকারীদের। জিসিডিটি জানিয়েছে, সংরক্ষণাগারটিতে পুরু শিলাখণ্ড ও স্থায়ী বরফাচ্ছাদিত অঞ্চল থাকায় সেখানে বিদ্যুৎ না থাকলেও বীজগুলো হিমায়িত থাকবে। সূত্র: বিবিসি