ফেসবুক বন্ধু না শত্রু?

মার্ক জাকারবার্গ। ছবি: রয়টার্স
মার্ক জাকারবার্গ। ছবি: রয়টার্স

‘ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ হচ্ছেন অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া সেই অনাহূত অতিথির মতো, যিনি গেরস্থের বান্ধবীকে চুমুও খেয়ে যাবেন, শ্যাম্পেনও পান করবেন কিন্তু উপহারের ক্ষেত্রে লবডঙ্কা।’ এ বক্তব্য এক টেলিকম অপারেটর প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তির। ফেসবুক থেকে জাকারবার্গ কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ কামাচ্ছেন কিন্তু তা থেকে একটুকু সুবিধা করতে পারছে না টেলিকম অপারেটররা। তাই জাকারবার্গ আর তাঁর ফেসবুকের সমালোচনা করে এই ওপরের উক্তিটি করেছেন ওয়্যারলেস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ডিজিসেল গ্রুপের চেয়ারম্যান ডেনিস ও’ব্রায়েন।
টেলিকম অপারেটরদের কাছে ফেসবুক এখন বন্ধু নাকি শত্রু? ২ মার্চ থেকে স্পেনের বার্সেলোনায় শুরু হওয়া মোবাইলে ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে ফোন সেবাদাতা ও ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক এখন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর এক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে সেই তথ্য।
ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ জানিয়েছে, তাঁর লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্বের আরও কয়েক শ কোটি মানুষকে ইন্টারনেট সংযোগ সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা। কিন্তু নেটওয়ার্ক নির্মাতা হিসেবে টেলিকম অপারেটররা ফেসবুককে এখন ‘সমস্যা’ হিসেবেই দেখছে। তাঁদের কাছে, ফেসবুক ও গুগলের মতো ইন্টারনেট-ভিত্তিক বড় বড় প্রতিষ্ঠান মুনাফার বেশির ভাগই হাতিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু অবকাঠামো নির্মাণসহ অন্যান্য ব্যয় করতে হচ্ছে অপারেটরদের। ইন্টারনেট কোম্পানিগুলো বিনা মূল্যে কলিং ও বার্তা পাঠানোর অ্যাপ ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে টেলিকম অপারেটরদের লাভ কমিয়ে দিচ্ছে। এর পাশাপাশি বিনা মূল্যের অ্যাপ থেকে তারা বিজ্ঞাপন দিয়ে আয়ও করছে। আর টেলিকম অপারেটররা পাচ্ছে কী?
দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের ৩২টি দেশে ওয়্যারলেস সেবাদাতা ডিজিসেলের চেয়ারম্যান ডেনিস ও’ব্রায়েন ফেসবুকের সরাসরি সমালোচনা করেছেন। ফেসবুক ছাড়াও গুগলের সমালোচনা করে ও’ব্রায়েন বলেন, ‘কোটি কোটি ডলার বিজ্ঞাপন থেকে আয় করছে গুগল কিন্তু তারা কাউকে এক পেনিও খরচ হিসেবে দেয় না। আমার মনে হয়, আধুনিক জগতের ইতিহাসে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যবসা।’
মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে ইন্টারনেট কোম্পানি ও টেলিকম সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দূরত্বের বিষয়টি এবারের মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে দেখা গেছে। ২ মার্চ মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে অংশ নিয়ে কিনোট উপস্থাপন করেন জাকারবার্গ। সেখানে তিনি টেলিকম অপারেটরদের মাধ্যমে কীভাবে ফেসবুক ডট ওআরজি ব্যবহার করে সারা বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বাড়ানো যায়, তা নিয়ে কথা বলেন।
জাকারবার্গ অবশ্য টেলিকম অপারেটরদের দুঃখ বুঝতে পেরেছেন। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, টেলিকম সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে এবং উভয় পক্ষই যাতে লাভবান হয়, তা বের করার চেষ্টা করা হয়েছে।
গত বছর বার্সেলোনায় টেলিকম অপারেটরদের জন্য ডিজিসেলের মতো বিভিন্ন টেলিকম অপারেটরদের জন্য রাতের খাবারের আয়োজন করেছিলেন জাকারবার্গ। সেখানেই ফেসবুক ও টেলিকম অপারেটরদের মধ্যকার দূরত্ব দূর করার চেষ্টা চালান জাকারবার্গ। এ বছরও সেই একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছেন তিনি।
এদিকে গুগল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা এমন প্রযুক্তি তৈরি করছে, যাতে সাশ্রয়ী খরচে অনলাইন ব্রাউজ করা যাবে। এ রকম প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে বেলুনের মাধ্যমে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা। গুগলের একজন মুখপাত্র বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যানালাইসিস ম্যাশনের একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেন যাতে বলা হয়, ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠানগুলো বার্ষিক তিন হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার সমুদ্রের নিচে সাবমেরিন কেব্‌ল তৈরির মতো অবকাঠামো নির্মাণে খরচ করছে।
ইন্টারনেট কোম্পানি ও টেলিকম অপারেটরদের মধ্যে শীতল যুদ্ধ শুধু ইন্টারনেট সংযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিষয়েই এখন আর সীমাবদ্ধ নেই। ইউরোপের টেলিকম অপারেটররা তো রীতিমতো অভিযোগ তোলা শুরু করেছে। গুগল বিনা মূল্যে নানা সুবিধা নিচ্ছে বলে তাদের অভিযোগের অন্ত নেই। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রেও ‘ইন্টারনেট সমতা’ নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ হয়ে গেল। তবে বিষয়টি উন্নয়নশীল দেশগুলোয় যে মোবাইল অপারেটররা কাজ করছে, তাদের জন্য বেশি দুশ্চিন্তার কারণ। কেননা, সেখানে ওয়্যারলেস ইন্টারনেট সেবা থেকে তাদের আয় আশানুরূপ হচ্ছে না। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মোবাইল অপারেটরদের মুনাফা কল ও বার্তা থেকে বেশি আসে।
ফেসবুক কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, অতিরিক্ত অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়াই তারা আরও বেশি মানুষকে অনলাইনে আনতে সক্ষম। কারণ, ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ এখন কোনো না কোনোভাবে ইন্টারনেট সংকেতের মধ্যে চলে এসেছে। কিন্তু এদের মধ্যে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। কারণ, ইন্টারনেটের সুবিধা সম্পর্কে তারা অবগত নয়। বিনা মূল্যে তাদের জন্য ফেসবুক ব্যবহারের সুযোগ করে দিলে মোবাইল অপারেটররা লাভবান হবে। ইতিমধ্যে ফেসবুক বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ বিষয়ক চুক্তিও করে ফেলেছে।
সিলিকন ভ্যালির দৃষ্টিকোণ থেকে উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য এ ধরনের চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী দশকে ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠান আরও মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। কিন্তু গত চার বছরে মানুষের ইন্টারনেট সংযোগে যুক্ত হওয়ার হার কমে গেছে। প্রযুক্তি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাকিনসের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইন্টারনেট ব্যবহার বৃদ্ধির হার ছিল ১৫ শতাংশ কিন্তু পরের চার বছরে তা কমে ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। এর হার আরও কমতে পারে।
ফেসবুক জিরো
পাঁচ বছর আগে টেলিকম অপারেটরদের কাছে ‘ফেসবুক জিরো’ নামে একটি সেবা চালু করার প্রস্তাব দিয়েছিল ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। এতে ফেসবুক ব্যবহারে কোনো ডাটা খরচ দিতে হয় না ব্যবহারকারীদের। আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার টেলিকম অপারেটর মিলিকম প্রথম ফেসবুকের এই অফার গ্রহণ করে। প্যারাগুয়েতে মিলিকমের টিগো ব্র্যান্ডের অধীনে ২০১৩ সালে প্রথম ছয় মাস ফেসবুক জিরো চালু করার পর মোবাইল ডেটা ব্যবহারকারী ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। প্রতি ১০ জন ব্যবহারকারীর মধ্যে চারজন নতুন ব্যবহারকারী মোবাইল ইন্টারনেট সার্ভিসে অর্থ খরচ করেন।
টিগোর নির্বাহী পরিচালক মারিও জানোত্তি বলেন, ‘অনেক মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের অভিজ্ঞতার বাইরে রয়ে গেছে। এই অফারে তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু দেখা যায় কয়েক মাস পরে এই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ধরে রাখা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়।’
ফেসবুক জিরো প্রকল্পের মাধ্যমে টেলিকম অপারেটররা মুনাফা করতে পারছে না, বিষয়টি ফেসবুক কর্তৃপক্ষও বুঝতে পেরেছে। গত বছর তাই ফেসবুকের সেই পরিকল্পনাতে পরিবর্তন করে বিনা মূল্যে ফেসবুক ব্যবহারের পাশাপাশি অন্যান্য ফিচার সুবিধার অ্যাপ উন্মুক্ত করেছে ফেসবুক, যাতে ব্যবহারকারীরা আরও বেশি অর্থ খরচ করতে রাজি হয়। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় খবর, আবহাওয়া, স্বাস্থ্যসুবিধাসহ নানা বিষয় সহজে জানার জন্য ইন্টারনেট ডট ওআরজির ঘোষণা দেয়। বর্তমানে জাম্বিয়া, তানজানিয়া, ভারত, ঘানা, কেনিয়া ও কলম্বিয়ায় এই অ্যাপটি টেলিকম অপারেটরদের মাধ্যমে চালু করেছে ফেসবুক।
বিনা মূল্যে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ব্যবহারের সুবিধা দিয়ে জ্যামাইকাতে নির্দিষ্ট প্যাকেজ চালু করে ডিজিসেল। ও’ব্রায়েন বলেন, এই সুবিধা চালু করার ফলে ২৫ শতাংশ ডেটা ট্রাফিক বাড়ে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, শুধু ফেসবুক বিনা মূল্যে দিলে বেশি মানুষকে অনলাইনে আনা যাবে না। এটা করতে হলে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। এ জন্য দরকার হবে নেটওয়ার্ক যন্ত্রপাতি স্থাপন। গত কয়েক দশকে এই অবকাঠামো নির্মাণ, স্থানান্তর করতে হেলিকপ্টার থেকে শুরু করে গাধা পর্যন্ত ব্যবহার করতে হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার অরেডো গ্রুপ মিয়ানমারে নেটওয়ার্ক সেবার জন্য অবকাঠামো তৈরি করছে। এই অবকাঠামো তৈরিতে যে খরচ তা তুলে আনতে এক দশক লেগে যেতে পারে।
লাভের টাকা কার পকেটে যাবে?
নেটওয়ার্ক সেবা বাড়াতে গুগল ও ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো অবশ্য বসে নেই। স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ, ইন্টারনেট বেলুন, ড্রোন বা চালকবিহীন বিমানের মতো প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে তারা। কিন্তু এ ধরনের প্রযুক্তি আলোর মুখ দেখতে এখনো অনেক দেরি আছে। তাই টেলিকম অপারেটররা বলছেন, তাঁদের বিনিয়োগ টেকসই না-ও হতে পারে। এখন মোবাইল অ্যাপসই তাদের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভারত, রাশিয়া ও ব্রাজিলের মোবাইল অপারেটররা দাবি করছে, গত বছরেই ভয়েস কল ও টেক্সট বার্তা থেকে তাদের ২৪০ কোটি মার্কিন ডলারের মতো মুনাফা কমে গেছে সেই তুলনায় তাদের ডাটা খাত থেকে আয় হয়েছে ৮০ কোটি মার্কিন ডলার।
অরেডোর প্রধান নির্বাহী নেসার মারাফি এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, যদি ইন্টারনেট কোম্পানিগুলো টেলিকম অপারেটরদের সরাসরি মুনাফার ভাগ দিতে শুরু না করে তবে বিনিয়োগ শিকেয় উঠবে। প্রশ্ন দাঁড়াবে, অবকাঠামো তৈরিতে বিনিয়োগ করবে কে? গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এক সাক্ষাত্কারে মারাফি বলেন, ‘আমরা নেটওয়ার্ক বানাব, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুনাফা লুটবে ইন্টারনেট কোম্পানিগুলো যারা সেই মুনাফার যৎসামান্যও আমাদের দেবে না।’