আটঘাট বেঁধে নামছে নকিয়া

নকিয়ার তৈরি অ্যান্ড্রয়েডনির্ভর ট্যাব
নকিয়ার তৈরি অ্যান্ড্রয়েডনির্ভর ট্যাব

মোবাইল ফোন ব্যবসায় ফিরতে আটঘাট বেঁধে নামছে ফিনল্যান্ডের প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান নকিয়া। সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞ নিয়োগ, নতুন প্রযুক্তিপণ্য পরীক্ষা ও বিপণন সহযোগী খোঁজার উদ্যোগ তারই প্রমাণ।

মাইক্রোসফটের কাছে মোবাইল ফোন বিভাগ বিক্রি করে দেওয়ার পর আবার মোবাইল ফোনের বাজারে ফিরে আসতে এখন বহুমুখী প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির মধ্যে। আজ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
রয়টার্স বলছে, স্মার্টফোনের উত্থানের যুগে কিছু ভুল পদক্ষেপের কারণে অ্যাপল ও স্যামসাংয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে বাজার হারিয়েছিল এক সময়ের বিশ্বের বৃহত্তম মোবাইল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নকিয়া। ২০১৩ সালের শেষ দিকে এসে মাইক্রোসফটের কাছে মোবাইল ফোন বিভাগটি বিক্রি করে দিয়ে টেলিকম নেটওয়ার্কিং যন্ত্রপাতির ব্যবসায় মনোনিবেশ করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। এখন নকিয়ার প্রধান নির্বাহী রাজিভ সুরী আবার মোবাইল ফোন ব্যবসায় ফেরার পরিকল্পনার কথা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন। তবে নকিয়ার নাম ব্যবহার করে স্মার্টফোন তৈরি করতে হলে তাঁকে ২০১৬ পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে। কারণ নকিয়ার সঙ্গে মাইক্রোসফটের যে চুক্তি তাতে ওই সময়ের আগ পর্যন্ত নকিয়া নিজের ব্র্যান্ডের কোনো মোবাইল ফোন বাজারে আনতে পারবে না। তবে বাজার ফেরার জন্য নকিয়ার প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরেই।
নকিয়া ইতিমধ্যে বাজারে ফেরার লক্ষ্য বাস্তবায়নে অনেকটা এগিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে চীনের বাজারে নকিয়া ব্র্যান্ড নাম দিয়ে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমনির্ভর এন ১ নামের ট্যাবলেট কম্পিউটার বাজারে ছেড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়াও নকিয়ার ‘পুনর্জন্ম’ হিসেবে ‘ভারচুয়াল রিয়েলিটি ক্যামেরা’ উন্মুক্ত করেছে। শুধু হার্ডওয়্যার নয়, নকিয়া এখন সফটওয়্যারকেও গুরুত্ব দিচ্ছে। অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের জন্য স্মার্টফোনে কনটেন্ট ব্যবস্থাপনার অ্যাপ ‘জেড লঞ্চার’ উন্মুক্ত করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
নকিয়ার তোড়জোড় লক্ষ্য করা যায় এর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে। পণ্য উন্নয়ন বিশেষ করে অ্যান্ড্রয়েড প্রকৌশলী নিয়োগে লিঙ্কডইনে ডজন খানেক বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ভবিষ্যতে অ্যান্ড্রয়েড প্ল্যাটফর্মনির্ভর পণ্য তৈরির লক্ষ্য নকিয়ার। এর আগে নকিয়ার পণ্য বিভাগ থেকে ৭০ জন কর্মী ছাঁটায়ের ঘোষণা দিলেও তা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে বলে রয়টার্সকে জানিয়েছে নকিয়ার একটি সূত্র।
নকিয়ার প্রস্তুতি
বাজারে ফেরার প্রস্তুতি সম্পর্কে নকিয়া বিস্তারিত কিছু না বললেও ৬০০ কর্মীর শক্তিশালী একটি কারিগরি বিভাগ চালুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। মোবাইল ফোনসহ, ডিজিটাল ভিডিও, স্বাস্থ্য বিষয়ক কনটেন্ট ও নতুন প্রযুক্তিপণ্য তৈরি হবে এই বিভাগটির কাজ।
অবশ্য বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, নকিয়ার ফেরার পথটি খুব মসৃণ হবে না। দ্রুত পরিবর্তনশীল ও প্রতিযোগিতার এই বাজারে অ্যাপলের মতো প্রতিষ্ঠান যেখানে স্মার্টফোন মুনাফার ৯০ শতাংশ ঘরে তুলছে সেখানে নকিয়াকে বড় পরীক্ষা দিতে হবে। তবে নকিয়ার একটি বাড়তি সুবিধা আছে আর তা হচ্ছে এর পেটেন্ট ও মেধাস্বত্ব। প্রায় দুই দশক ধরে প্রচুর অর্থ খরচ করে যে পেটেন্ট ভান্ডার নকিয়া গড়ে তুলেছে তা নিশ্চয়ই নষ্ট করতে চাইবে না।
নকিয়ার আরেকটি বাড়তি শক্তি হিসেবে যুক্ত হবে অ্যালকাটেল-লুসেন্টের বিশেষজ্ঞরা। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে এক হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে টেলিকম যন্ত্রাংশ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটিকে কেনার ঘোষণা দিয়েছে নকিয়া।
নকিয়া কর্তৃপক্ষ বলছে, অতীতে যে ভুল হয়েছে তার আর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। প্রযুক্তি ট্রেন্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে। গ্রাহকদের রুচির সঙ্গে পরিবর্তিত হওয়ার ক্ষেত্রে যে নকিয়া ধীর গতিতে এগিয়েছে সেই নকিয়া এখন ছুটবে তিরের গতিতে।
ফোনের ব্যবসার ঝুঁকি এড়াতে নকিয়া কিছুটা ভিন্নপথে হাঁটছে। ‘ব্র্যান্ড লাইসেন্স’ দিতে সহযোগী খুঁজছে প্রতিষ্ঠানটি। নকিয়ার সঙ্গে যে প্রতিষ্ঠান চুক্তি করবে তাদের নকিয়া নামে ফোন বিক্রি করতে দেবে তারা। নকিয়া ফোনের নকশা, পেটেন্ট ব্যবহারের সুযোগ দেবে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠাটি ফোন তৈরি, বিপণনের কাজ করবে। নকিয়া শুধু রয়্যালটি নেবে।
নকিয়ার প্রধান নির্বাহী রাজিভ সুরী বলেন, প্রচলিত পদ্ধতিতে আর ফিরবে না নকিয়া। এর পরিবর্তে ব্র্যান্ড লাইসেন্স বিক্রি করে আরও লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। নকিয়াকে লাভজনক করতে সম্প্রতি হেয়ার ম্যাপ ব্যবসাটিও বিক্রি করে দিয়েছে নকিয়া।
বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান গার্টনারের বিশ্লেষক সিলভিয়ান ফাবরি বলেন, নকিয়া আরও উদ্ভাবনী এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হতে চাইছে।

নকিয়ার তৈরি স্মার্টফোন
নকিয়ার তৈরি স্মার্টফোন

নকিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী
প্রযুক্তিবিশ্বে ব্র্যান্ড লাইসেন্সের বিষয়টি একেবারে আনকোরা নয়। এর আগে ইউরোপিয়ান কোম্পানি ফিলিপস ও অ্যালকাটেল এশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ব্র্যান্ড লাইসেন্স দিয়ে প্রচুর মুনাফা করেছে। তবে স্মার্টফোনের বাজারে চীনের শিয়াওমি ও ভারতের মাইক্রোম্যাক্সের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্র্যান্ড লাইসেন্স দিয়ে সেখান থেকে মুনাফা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। চুক্তিভিত্তিক ফোন তৈরি ও সফটওয়্যারের মানোন্নয়নের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে ফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে নতুন ফোন বাজারে আনা কঠিন কোনো কিছু নয়।
বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিসিএস ইনসাইটের বিশ্লেষক বেন উড বলেন, ‘সামনের বছরগুলোতে আমরা প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা দেখতে পাব। এখন ফোনের বাজারে ঢোকার বাধা টপকানো অনেক সহজ। যে কেউ চাইলে স্মার্টফোনের বাজারে ঢুকে যাচ্ছে। নকিয়ার ক্ষেত্রে সফল হতে গেলে ব্র্যান্ডের মূল্যটাই বড়। তবে এটা এখন বিতর্কের বিষয়।’
নকিয়ার দাবি, তাদের ব্র্যান্ডটিকে বিশ্বের ৪০০ কোটি মানুষ চেনে। তবে বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারব্র্যান্ডের ভাষ্য, এক সময়ে ব্র্যান্ডের তালিকায় শীর্ষ পাঁচের মধ্যে নকিয়ার অবস্থান থাকলেও ২০০৯ সালের পর থেকে নকিয়ার ব্র্যান্ডটি পিছিয়ে যেতে শুরু করে। এখন নকিয়ার জন্য শীর্ষ ১০০টি ব্র্যান্ডের মধ্যে জায়গা পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
নকিয়ার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা আনসি ভ্যানজোকি বলেন, ‘বাজারে যদি কোনো ব্র্যান্ড দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত থাকে মানুষ ধীরে ধীরে তা ভুলে যেতে শুরু করে। বাজারে এখন যে ধরনের পণ্য রয়েছে সে ধরনের পণ্যই যদি আবার আনা হয় তবে ব্র্যান্ড নামে খুব বেশি হেরফের হয় না। যদি নতুন কিছু এবং ক্রেতাদের মনপছন্দের জিনিস হয় তবেই পুরোনো ঐতিহ্যের কথা ভেবে মানুষ তা কিনতে পারে।’