আঁধার ঘরে চাঁদের আলো

রুনা আক্তারের বাবা মো. নুরুজ্জামান দিনমজুর। মা আসমা বেগম পরের বাড়িতে ‘পেট চুক্তি’তে করেন ঝিয়ের কাজ। সারা দিন পর নিজের জন্য যেটুকু খাবার বরাদ্দ পান আসমা বেগম, তা না খেয়ে বাড়িতে নিয়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খান। দিনমজুর বাবা ও ঝিয়ের কাজ করা এই মায়ের স্বপ্ন ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করবেন।
লেখাপড়া না জানা বাবা-মায়ের এমন স্বপ্নে ভর করে রুনা এবার এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ের রুনার মতোই অতিকষ্টে পড়াশোনা করে সুনামগঞ্জের হৃদয়, রাজবাড়ীর রিফাত আর বগুড়ার রুবাইয়াও জিপিএ-৫ পেয়ে তাদের আঁধার ঘরে আলো জ্বেলেছে।
পরীক্ষার রাতেও রুনার কান্না

রুনা আক্তার
রুনা আক্তার

ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার জগথা ডাঙ্গীপাড়া মহল্লার মো. নুরুজ্জামানের মেয়ে রুনা আক্তার। পীরগঞ্জ সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে সে।
দিনমজুর বাবা আর মা ঝিয়ের কাজ করে কষ্টের সংসার। রুনার এ মায়েরই আবার দুটি কিডনি নষ্ট। ব্যথায় মাঝেমধ্যেই কাজে যেতে পারেন না। কিন্তু কাজ না করলে বাড়িতে ঠিকমতো খাবার জোটে না। ঝিয়ের কাজটা গেলেও যে বিপদ। সব ভেবে অসুস্থ মাকে বিছানায় রেখে রুনাই যায় মায়ের কাজ করতে। কাজ শেষে ভাত এনে বাসায় খাওয়ায় মাকে।
রুনাদের অভাব কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। অনেক সময় রাতে পড়ার জন্য হারিকেনের তেল কেনার টাকা জোটে না। এ অভাবের মধ্যেও অষ্টম শ্রেণিতে রুনা বৃত্তি পেয়েছে। সেদিন রুনাদের ঘরে গিয়ে দেখা যায়, রুনার মা কিডনির ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। জানালেন, রুনা অন্যের বাড়িতে কাজ করতে গেছে। রুনার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ভাই অন্যের বাড়ি থেকে ডেকে আনলে কথা হয় তার সঙ্গে।
রুনা বলে, ‘আমি ভালোভাবে পাস করেছি, কিন্তু সংসারের অভাবটা তো আর যায় না। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে আমাদের মুখে ভাত দেন। এখন তিনি অসুস্থ। তাই মায়ের বদলে কাজ করছি। তাতে কী? আমি আরও অনেক দূর যেতে পারব।’
রুনার মা বলেন, ‘পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষার আগের রাতে রুনা পড়তে না বসে কাঁদছিল। হারিকেনে তেল নেই জানতে পেরে পাশের বাড়ি থেকে ধার নিয়ে ১০ টাকার তেল কিনে দিলে রুনা রাত জেগে পড়ে। আল্লাহ মেয়েকে ওই সাবজেক্টটাতেও গোল্ডেন দিয়েছে।’
বাবা বললেন, ‘দিনমজুরির টাকায় সংসার চলে না। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর পড়ার খরচের কথা ভাবলে মাথাটা ঘুরে ওঠে। কেমনে মেয়েটাকে কলেজে পড়াই?’
বাবার সঙ্গে ধোপার কাজে হৃদয়

হৃদয় চন্দ্র দাস
হৃদয় চন্দ্র দাস

বাবা বিনোদ চন্দ্র দাস ধোপার কাজ করেন। সঙ্গে অন্যের জমিতে বর্গাচাষ। পড়াশোনার ফাঁকে বাবাকে কাজে সহায়তা করে মেধাবী ছেলে হৃদয় চন্দ্র দাস। সে এবার সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার বাদশাগঞ্জ পাবলিক হাইস্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। জেএসসি ও পিএসসিতেও গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছিল সে।
চার ভাইয়ের মধ্যে হৃদয় সবার ছোট। সবার বড় ভাই দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। দ্বিতীয় ভাই ডিগ্রিতে পড়ছে। তৃতীয় ভাই বেশ কিছুদিন আগে কাজের সন্ধানে ঢাকায় চলে গেছে। গত সোমবার হৃদয়দের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, জরাজীর্ণ টিনের ঘর। ঘরের এক কোণে পুরোনো একটি টেবিল ও ভাঙা চেয়ার।
হৃদয়ের বাবার সামনে তাঁর ছেলের ভালো ফলাফলের বিষয় তুললে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, ‘পোলাডা তো রিজাল্ট ভালাই করছে। নিজেরা অহন দুই বেলা খাইতে গিয়াই হিমশিম খাই। কলেজে ভর্তি করাইতে গিয়া টেহা কই ফাইয়াম? কিতা যে করতাম হেই চিন্তায় রাইতে ভালা কইর্যাই চোউহে ঘুম আয় না।’
মা মীনা রানী দাস ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে কদিন ধরেই ডুবে রয়েছেন চিন্তায়। আলাপচারিতায় বলেন, ‘হৃদয় স্বপ্ন দেখতাছে হে ডাক্তার অইবো, আমরার তো জমিজমাও নাই। কীভায় যে পোলাডার স্বপ্নপূরণ অইবো তা ওপরওয়ালাই জানেন।’
জানা গেল, হৃদয়দের সম্পদ বলতে বাড়ির ওই একচিলতে ভিটেটুকু। এক জামা পরেই প্রতিদিন সে স্কুলে যেত। অভাবের সংসারে নতুন জামা না পেলেও অতৃপ্ত ছিল না কখনোই। বাড়ি থেকে আট কিলোমিটার হেঁটেই স্কুলে আসা-যাওয়া করত। টিফিনও সারত এক গ্লাস পানিতেই।
বন্ধুর বই পড়েই জিপিএ-৫ রিফাতের

রিফাত শেখ
রিফাত শেখ

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের ছেলে রিফাত শেখ। বাবা মুঞ্জুরুল শেখ পোলট্রি খামারের কর্মচারী। মা নিলুফা ইয়াসমিন গৃহিণী। বাবা খামার থেকে যে সামান্য বেতন পান, তা দিয়েই টেনেটুনে চলে পাঁচ সদস্যের সংসার।
বাবা-মার সামর্থ্যে না কুলানোয় বন্ধুর বই পড়েই এ বছর গোয়ালন্দ নাজির উদ্দিন পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে রিফাত।
তিন ভাইয়ের মধ্যে রিফাতই সবার বড়। পড়াশোনার খরচ জোগাতে মাঝেমধ্যে টিউশনি করাত। প্রতিদিন সময় করে ঘনিষ্ঠ বন্ধু মহিউল ইসলাম অন্তুর বাড়িতে গিয়ে তার বই নিয়ে পড়ত। রিফাত পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতেও ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল।
রিফাত জানায়, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির পর বাবা তাকে শার্ট-প্যান্ট কিনে দেন। সেই কাপড়েই দশম শ্রেণি পর্যন্ত চলেছে। পরে শার্ট খাটো হয়ে যাওয়ায় এসএসসি পরীক্ষার আগে ফুটপাত থেকে ১৫ টাকায় একটি পুরাতন শার্ট কিনেছে। সেই শার্ট গায়ে দিয়েই এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।
রিফাত ভালো ফুটবলারও। ২০০৯ সালে আন্তঃ প্রাথমিক স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টে উপজেলায় শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে পুরস্কৃত হয় সে।
রিফাত চিকিৎসক হতে চায় জানিয়ে তার বাবা বলেন, ‘কিন্তু কীভাবে পড়াশোনা করাব ভেবে পাই না। আল্লাহ আমায় সে সামর্থ্য দেন নাই যে ওর চাহিদা পূরণ করতে পারব। আমি ওর জন্য সবার সহযোগিতা চাই।’
আইনজীবী হতে চায় রুবাইয়া

রুবাইয়া ইয়াসমিন
রুবাইয়া ইয়াসমিন

বাবা-মায়ের অভাবের সংসার। তাই লেখাপড়ার পাশাপাশি টুপি ও অন্যের সেলাই মেশিনে জামা-কাপড় তৈরি করে সংসারের চাহিদা মিটিয়েছে রুবাইয়া ইয়াসমিন। এরপরও সে বগুড়ার ধুনট উপজেলার কালেরপাড়া দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
রুবাইয়ার বাবা গোলাম রব্বানী সরকারের নিজের কোনো জমি নেই। তাই অন্যর জমিতে বর্গাচাষ করেন। মা আশরাফুন খাতুন গৃহিণী। বড় ভাই আরিফুল ইসলাম টিউশনি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। বড় বোন রোজিনা খাতুন পোশাক কারখানার শ্রমিক।
রুবাইয়াদের ধুলাউড়ীপাড়া গ্রামের বাড়িতে কোনো বিদ্যুৎ নেই। কখনো কখনো কেরোসিনের তেল কেনার টাকা থাকত না। তাই দিনের বেলায় বেশি লেখাপড়া করেছে সে। রুবাইয়া অষ্টম শ্রেণিতেও বৃত্তি পেয়েছে। তিন ভাইবোনের মধ্যে সেই ছোট। মা-বাবা ভালোভাবে পেটের ভাত জোগাতে না পারলেও মেয়ের প্রতি ভালোবাসার কমতি ছিল না তাঁদের। তাই তো সব কষ্ট পেছনে ফেলে ভালোবাসার মূল্য দিয়েছে সে।
রুবাইয়া বলে, ‘আমরা অভাবী পরিবারের মানুষ। তাই কষ্ট কী আমি বুঝি। গ্রামগঞ্জে অনেক অভাবী পরিবারের মেয়েরা নির্যাতিত হয়ে আইনের কাছে বিচার পায় না। আমি লেখাপড়া শিখে আইনজীবী হয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই।’

{প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন: পীরগঞ্জ (ঠাকুরগাঁও), ধরমপাশা (সুনামগঞ্জ), গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) ও ধুনট (বগুড়া) প্রতিনিধি}