কষ্টের মাঝেও সেরা সাফল্য

হারুন মিঞার বস্তিতে থাকে শারমিনের পরিবার। কাঠ ও টিনের ভাঙাচোরা ছোট একটি ঘর। বৃষ্টিতে পানি পড়ে। শীতে হাড়কাঁপানো বাতাস। এ ঘরেই তার সঙ্গে থাকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাবা, অসহায় মা আর দারুণ মেধাবী ছোট ভাই। এ জীবনে কত দিন না খেয়ে স্কুলে যেতে হয়েছে সে হিসাবটা রাখা হয়নি তার। তাই তো লাজুক হেসে বুঝিয়ে দেয়, হিসাবের এ খাতাটা যথেষ্টই ভারী হয়েছে তার।
এমনই থাকার কষ্ট, না খাওয়ার কষ্ট, পড়ার কষ্ট—সব কষ্টকে উপেক্ষা করেই এ বছর এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে প্রথম আলো বাগেরহাট বন্ধুসভার সদস্য শারমিন। তার মতোই নানা কষ্টের মাঝে একই রকম সাফল্য পেয়েছে লালমনিরহাটের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মোকাদ্দেস ও মোকলেছ। পেয়েছে অতিদরিদ্র ঘরের মাগুরার তাসলিমাও।
চিকিৎসক হবে বন্ধুসভার সদস্য শারমিন

শারমিন সুলতানা
শারমিন সুলতানা

বাগেরহাট সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে বন্ধুসভার সদস্য শারমিন সুলতানা। জেএসসিতেও একই ফল করেছিল মেয়েটি। তার ইচ্ছা ভবিষ্যতে চিকিৎসক হবে।
ভালো ফল করেও দুশ্চিন্তা ভর করেছে শারমিনের কাঁধে। ‘কঠিন কষ্টের একটা সময় পার করে এক ঝলক সাফল্য পেয়েছি। এ জন্য আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ, যাঁরা সব সময় আমার পাশে ছিলেন। কিন্তু সামনের সময় আরও কঠিন, প্রতিযোগিতা আর খরচে ভরা। জানি না কী করব! কীভাবে সবকিছুর ব্যবস্থা হবে।’ এভাবেই নিজের দুশ্চিন্তার কথা গুছিয়ে বলল শারমিন।
বাগেরহাট শহরের মিঠাপুকুরপার মসজিদসংলগ্ন হারুন মিঞার বস্তিতে থাকে শারমিন। ছোট ভাইও এ বছর জিপিএ-৫ পেয়ে জেএসসি উত্তীর্ণ হয়েছে। মা মর্জিনা বেগম জানান, পরিবারের আয় বলতে পাঁচ হাজার টাকা। তা আসে অসুস্থ স্বামী আতিয়ার রহমানের অবসর ভাতা থেকে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন তিনি। এখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত। তাঁর চিকিৎসা আর ওষুধেই যায় অর্ধেক টাকা। বাকি টাকায় ঘরভাড়া, বাজারসদাই, কাপড়চোপড়।
মর্জিনা বেগম বলেন, ‘ছেলেমেয়ে দুটোর মাথা ভালো। পড়তে চায়, ভালো পাস দেয়। কিন্তু আমি মাস্টার দিতি পারি না, খাতি দিতি পারি না। অসুস্থ স্বামী আর সংসার রেখে কাজে যাতি পারি না।’ জানালেন, মানুষের সাহায্যের ওপরই চলে ছেলেমেয়ে দুটোর লেখাপড়া। ভর্তির খরচ, স্কুল পোশাক, পরীক্ষার ফি, কাগজ-কলম, নোট-বই সবই মানুষের দেওয়া। মানুষের দরজায় ঘুরে নিজের ওপরে বিরক্ত এই মায়ের প্রশ্ন, ‘কন, এইভাবে কত মাইনষের কাছে হাত পাতা যায়?’
শারমিনদের ঘরে গিয়ে দেখা যায়, আধো-অন্ধকার, ছোট ঘরটির টিনের চালে অসংখ্য ফুটো। কাঠের বেড়াটিও একই রকম। ঘরের সঙ্গে ছোট এক চিলতে বারান্দার কোণে শারমিন ও তার ভাইয়ের পড়ার টেবিল। জানা গেল, বৃষ্টির দিন পানি ঢুকে বই-খাতা, বিছানা ভিজে যায়। শীতকালে ঠান্ডা বাতাসের কষ্ট। টাকার অভাবে কয়েক বছর ঘরটি মেরামত করা যায়নি। পলিথিনে জোড়াতালি দিয়েই চলছে এত দিন।
এদিকে কলেজে ভর্তি হওয়া আর লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া নিয়ে একধরনের শঙ্কায় ভুগলেও মনের জোর হারায়নি শারমিন। বলল, ‘কলেজে ভর্তি হতে হবে। নিজেই নিজের পড়ার খরচ মেটাতে তাই টিউশনি খুঁজছি।’
মেধাশক্তির জয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মোকাদ্দেস ও মোকলেছের

মোকাদ্দেস হোসাইন, মোকলেছুর রহমান
মোকাদ্দেস হোসাইন, মোকলেছুর রহমান

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সাপ্টিবাড়ী উচ্চবিদ্যালয়ের দুই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী মোকাদ্দেস হোসাইন ও মোকলেছুর রহমানের মেধাশক্তির জয় হয়েছে। দুজনই মানবিক শাখা থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের এ দুই সদস্য সাপ্টিবাড়ী ইউনিয়নে সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষাকেন্দ্রের আবাসিক হলে থেকে পড়াশোনা করেছে। সাপ্টিবাড়ী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে এবার যে তিন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে, তাদের দুজনই এই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মোকাদ্দেস ও মোকলেছ।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট ইউনিয়নের বনগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা মোকাদ্দেসের বাবা আলমগীর হোসেন। একটি বেসরকারি বিমা কোম্পানিতে চাকরি করেন তিনি। যৎসামান্য আয়ে পরিবারের ছয় সদস্যের ভরণপোষণ করতে হিমশিম খেতে হয় তাঁকে। তাই অদম্য মেধাবী এই ছেলেকে হয়তো আর পড়াশোনা করানো সম্ভব হবে না বলে জানান তিনি।
মা মোর্শেদা বেগমেরও একই আশঙ্কা। বললেন, ‘তাহলে কি দৃষ্টিশক্তিহীন আমার এ ছেলে তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না? কেউ কি তার পাশে দাঁড়াবেন না?’ কিন্তু মোকাদ্দেস জানায়, সে আইনে পড়াশোনা করে আইনবিদ হতে চায়।
ওদিকে হাতীবান্ধা উপজেলার ধওলাই গ্রামে নানাবাড়ির ছোট এক টুকরো জমিতে বসবাস করতেন মোকলেছের বাবা আনোয়ার হোসেন। ছিলেন একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ২০১২ সালে তিনি মারা যান। বেঁচে থাকা অবস্থায় ছেলে মোকলেছুরের চোখের চিকিৎসায় সামর্থ্যের সবটাই ব্যয় করেন।
মোকলেছের বাবা মারা গেলে মা মনোয়ারা বেগম ঢাকায় গিয়ে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নেন; সঙ্গে নিয়ে যান দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে। আর মোকলেছের ঠাঁই হয় সাপ্টিবাড়ী সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষাকেন্দ্রের আবাসিক হলে।
মনোয়ারা বেগম বললেন, ‘আমি ঢাকার গার্মেন্টসে স্বল্প বেতনের চাকরি করি। অতিকষ্টে দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে ঢাকায় পড়াশোনা করাচ্ছি। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় মোকলেছুরের লেখাপড়ার ব্যয় অনেক বেশি। আমি তা কুলাতে পারি নাই। তাকে আমি কেমন করে এইচএসসিতে পড়াব?’
আর মোকলেছ জানায়, ইংরেজিতে পড়াশোনা করে সে চায় কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক হতে।
উড়োজাহাজ চালানোর স্বপ্ন তাসলিমার

তাসলিমা খাতুন
তাসলিমা খাতুন

মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার ভ্যানচালক বাবার মেধাবী মেয়ে তাসলিমা খাতুন। বাড়ি বলতে পাটকাঠির বেড়া, ছন আর পলিথিনের ছাউনি ঘেরা ঘর। চালের ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা যায়। রাতে বই-খাতার ওপর পড়ে চাঁদের আলো। তাই পড়ার ফাঁকে মুখ তুলে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে তাসলিমা। স্বপ্ন তাড়া করে বিমানচালক হওয়ার। ভাবতে ভাবতেই পড়ায় মন বসায়। রাত গড়িয়ে ভোর হয়।
উড়োজাহাজ চালানোর এ স্বপ্ন দেখা তাসলিমাই মহম্মদপুর উপজেলার বালিদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। বালিদিয়া দক্ষিণপাড়া গ্রামের অদম্য মেধাবী তাসলিমার বাবা শামসেল মোল্লা পেশায় ভ্যানচালক। বসতভিটার চার শতক জমি ছাড়া নেই কোনো জমিজমা।
মেয়ের ফলাফলে মা রমেসা খাতুনের চোখে আনন্দাশ্রু। তিনি পড়ালেখা জানেন না। জানেন না জিপিএ-৫ কী। বাড়িতে যখন লোকজন এসে বলছে, তোমার মেয়ে পরীক্ষায় ভালো ফল করেছে, তখন তিনি মেয়েকে জড়িয়ে শুধু কেঁদেছেন।
তাসলিমাদের প্রতিবেশী গোপীনাথপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ‘দারিদ্র্যসহ কোনো প্রতিকূলতাই আটকে রাখতে পারেনি তাসলিমাকে। সাহস, জয় করার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা আর হাড়ভাঙা পরিশ্রমে ভর করে আঁধার পেরিয়ে আলো ছুঁয়েছে সে।’
{প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন: প্রথম আলোর বাগেরহাট, লালমনিরহাট ও মাগুরা প্রতিনিধি}