আইন থাকলেও যথাযথ প্রয়োগ নেই এসিডের অপব্যবহার কমছে না

‘সাপের কামড় যে খেয়েছে, সে জানে এর কী যন্ত্রণা। এসিডে আক্রান্ত হয়ে যে পরিমাণ কষ্ট পেয়েছি, তা বোঝানো মুশকিল। আমাকে যারা এসিড ছুড়ে মেরেছিল, তাদের জেল-জরিমানা হলেও আইনি জটিলতার কারণে এখন পর্যন্ত জরিমানার টাকা পাইনি। জানি না আর কত দিন এ জ্বালা সইতে হবে।’ কথাগুলো বলছিলেন এসিড-সন্ত্রাসের শিকার সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার ভাতারিয়া গ্রামের শামসুল হক। শামসুলের মতো অনেক এসিডদগ্ধ এমন অনুভূতি জানিয়েছেন। এসিড নিয়ন্ত্রণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় এসিডের অপব্যবহার কমছে না। প্রতি মাসে কেউ না কেউ এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে। আক্রান্ত ব্যক্তিরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। সারা দেশে হাজারখানেক প্রতিষ্ঠান এসিড ব্যবহার করলেও অনুমতিপত্র সবার নেই। তারা অবৈধ উপায়ে এসিড সংগ্রহ করছে। জেলায় জেলায় জাতীয় এসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল থাকলেও বিক্রয় ও ব্যবহারের ওপর কোনো তদারকি নেই। যেমন, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের দপ্তরের লাইসেন্স শাখা সূত্রে জানা যায়, মাত্র সাতটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স রয়েছে। দিনাজপুরে রয়েছে ১৩ আর রংপুরে ১৭টি। ভোলায় ১৯টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে এসিড ব্যবহারের অনুমতি থাকলেও জেলায় অনেক ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এসিড ব্যবহার করে। বাকি সব প্রতিষ্ঠানের কোনো অনুমোদনপত্র (লাইসেন্স) নেই। সারা দেশে একই চিত্র। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রসচিব আবদুস সোবহান শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এসিড আইন সংশোধন করা হয়েছিল। আইনটি এখন পাস হওয়ার অপেক্ষায় আছে। নতুন আইন কার্যকর হলে এসিডের অপব্যবহার কমে যাবে। এ আইনে একটি জাতীয় কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হয়েছে। তিনি বলেন, এসিডদগ্ধদের সহায়তার জন্য সরকার আইনি সহায়তার পাশাপাশি আর্থিক সাহায্যও দিচ্ছে। এসিডদগ্ধ ফজিলাতুন নেছা বলেন, ‘সব জায়গায় দুর্নীতি, আমরা এসিডদগ্ধ হওয়ার পর জানি না, কী করতে হবে। থানা মামলা নিতে চায় না, পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন দিতে গাফিলতি করে। কোথাও আমরা সুবিচার পাই না।’ এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মনিরা রহমান বলেন, আইন থাকলেও যথাযথ প্রয়োগ নেই, এসিডের অপব্যবহার কমছে না। ২০০২ সালের ১৭ মার্চ প্রকাশিত গেজেটের ১ নম্বর আইনের সপ্তম অধ্যায়ে উল্লেখ আছে, ‘লাইসেন্স ব্যতীত এসিডের উত্পাদন, আমদানি, পরিবহন, মজুদ, বিক্রি ও ব্যবহার করা দণ্ডনীয় অপরাধ। যারা লাইসেন্স করবে না ও লাইসেন্সের শর্তগুলো পালন করবে না, তাদের জন্য অনূর্ধ্ব ১০ বছর ও অন্যূন তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং অতিরিক্ত ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।’ আবার এসিড ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীরা বলছেন, লাইসেন্স ফি কমানো দরকার। ভোলা সদর রোডের জয়ন্তী জুয়েলার্সের পরিচালক মৃদুল দে বলেন, ভোলার স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা খুব বড় ব্যবসায়ী নন। তাঁদের পুঁজি খুব সামান্য। এসিড ব্যবহার ও বিক্রির জন্য যে ফি ধার্য করা হয়েছে, তা খুব বেশি হয়ে গেছে। এসিড অপরাধ কঠোরভাবে দমনের উদ্দেশে ‘এসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২’ থাকলেও সাজা হয়েছে কম। আইনে আছে দহনকারী, ক্ষয়কারী ও বিষাক্ত যেকোনো পদার্থ এসিড। এসিড অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল: ট্রাইব্যুনালের বিচারক হবেন জেলা ও দায়রা জজ অথবা সমপদমর্যাদাসম্পন্ন, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজও এ অর্থে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। এসিডে মৃত্যু হলে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড। জরিমানা: অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড। এসিডে আহত করা হলে ক. দৃষ্টিশক্তি বা শ্রবণশক্তি সম্পূর্ণ বা আংশিক নষ্ট হলে, মুখমণ্ডল, স্তন বা যৌনাঙ্গ বিকৃত বা নষ্ট হলে, শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড। জরিমানা অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড। খ. শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ, গ্রন্থি বা অংশ বিকৃত বা নষ্ট হলে বা শরীরের কোনো স্থানে আঘাতপ্রাপ্ত হলে এর শাস্তি অনধিক ১৪ বছর কিন্তু অন্যূন সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড। জরিমানা অনূর্ধ্ব ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড। এসিড নিক্ষেপ করা বা নিক্ষেপের চেষ্টা করলে (ক্ষতি না হলেও) শাস্তি অনধিক সাত বছর কিন্তু অন্যূন তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড। জরিমানা অনূর্ধ্ব ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড। অপরাধে সহায়তা করলে এর শাস্তি মূল অপরাধীর সঙ্গে একই দণ্ডে দণ্ডনীয়। মিথ্যা মামলা বা অভিযোগ করলে এর শাস্তি অনধিক সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানা, অতিরিক্ত অর্থদণ্ড। জরিমানার অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি পাবেন। মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সরাসরি ট্রাইব্যুনালে লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে হবে। এসিড-সহিংসতার অপরাধ অ-আপসযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য। তবে জামিন দেওয়ার বিষয়টি আইনের বিধান অনুযায়ী আদালতের যুক্তিসংগত সন্তুষ্টির ওপর নির্ভর করে। জাতীয় এসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০০২ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত সারা দেশে এক হাজার ৪৯৬টি মামলা হয়েছে। অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে ৮৯১টির আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে ৫৭৫টির। এসব মামলায় মাত্র ১৩ জনের মৃত্যুদণ্ড, ৯৫ জনের যাবজ্জীবন আর অন্যান্য শাস্তি পেয়েছেন ১৬৫ জন। অর্থাত্ ২৭৩ জনের সাজা হয়েছে। মামলায় এক হাজার ৪৮৮ জন আসামি খালাস পেয়েছেন।