হাজার প্রতিষ্ঠানে এসিডের ব্যবহার অনুমোদন মাত্র ছয়টির

সাতক্ষীরায় এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় এসিডের অপব্যবহার কমছে না। জেলায় প্রতি মাসে কেউ না কেউ এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে। আক্রান্ত ব্যক্তিরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। জেলায় এসিড বিক্রির জন্য ছয়টি প্রতিষ্ঠানের অনুমতিপত্র (লাইসেন্স) রয়েছে। আর হাজার খানেক প্রতিষ্ঠান এসিড ব্যবহার করলেও অনুমতিপত্র নেই। তারা অবৈধ উপায়ে এসিড সংগ্রহ করছে। জেলা জাতীয় এসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল থাকলেও বিক্রয় ও ব্যবহারের ওপর কোনো তদারকি নেই। বেসরকারি সংস্থা স্বদেশের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জেলায় এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে ১২০ জন। ২০০১ সালের আগে হয়েছে আরও ১৯ জন। সব মিলিয়ে এ জেলায় এ পর্যন্ত এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে ১৩৯ জন। এর মধ্যে ৪৫ জন পুরুষ ও ৯৪ জন নারী। চলতি বছর ২২ জানুয়ারি শ্যামনগরের ছোটকুপুট গ্রামের রোজিনা খাতুন ও ১৪ ফেব্রুয়ারি আশাশুনির দক্ষিণ খাজরা গ্রামের নাসিমা খাতুন এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হন। ২০০৪ সালের ২৭ জুলাই প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটে উল্লেখ করা হয়েছে, লাইসেন্স ব্যতীত এসিড উত্পাদন, আমদানি, পরিবহন, বিক্রি, মজুদ ও ব্যবহার করা দণ্ডনীয় অপরাধ। জুয়েলারি সমিতির সভাপতি নিত্যানন্দ আমিন জানান, জেলায় ৪৮৮টি স্বর্ণের দোকান রয়েছে। সবার লাইসেন্স করার সামর্থ্য নেই। এ কারণে সবাই এসিড ব্যবহার করে না। নির্দিষ্ট কয়েকটি দোকান পালিশের কাজ করে, তারা এসিড ব্যবহার করে। অটো মোবাইল ওয়ার্কশপ মালিক সমিতির সভাপতি রাজা ইনতেশাব হোসেন জানান, তাঁদের সদস্যসংখ্যা ২০৫। ১৫-২০ জন ব্যাটারির কাজের সঙ্গে জড়িত। জেলায় শতাধিক বিদ্যালয় ও কলেজে বিজ্ঞানাগারে এসিড ব্যবহার ছাড়াও চামড়া, সুতা, রং ও শাঁখা তৈরির কারখানায়ও এসিড ব্যবহার করা হয়। জেলা প্রশাসকের দপ্তরের লাইসেন্স শাখা সূত্রে জানা যায়, সাতটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স রয়েছে। এর মধ্যে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিগুলো বিক্রির লাইসেন্স। এর মধ্যে একটি জুয়েলারি ও পাঁচটি ব্যাটারি অ্যান্ড কেমিক্যাল সার্ভিসের। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আবেদন করা ১৩টি পুলিশ সুপারের দপ্তরে, ২০টি বিভিন্ন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে ও পাঁচটি সাতক্ষীরা জেলা শিশুবিষয়ক কর্মকর্তার দপ্তরে তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। জেলা শহরের প্রভা জুয়েলার্সের মালিক প্রকাশ চৌধুরী জানান, তাঁর এসিড বিক্রির লাইসেন্স রয়েছে। প্রতি মাসে তিনি ৩০০ কেজি বিভিন্ন ধরনের এসিড বিক্রি করেন। এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ব্যবহারকারী কারও লাইসেন্স নেই। জজ আদালতের সাবেক পিপি তপন কুমার চক্রবর্তী জানান, এসিড অপরাধ দমন আইন অনুয়ায়ী এসিড নিক্ষেপ করা, নিক্ষেপের চেষ্টা করা বা সহায়তা করা, মিথ্যা মামলা করা বা করতে সহায়তা করা ইত্যাদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য। এসিড দ্বারা কোনো ব্যক্তিকে আহত করা বা মৃত্যু ঘটানোর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড। সদর উপজেলার মাছখোলার এসিডদগ্ধ নূর বানু, তালার সোনালি ও আঞ্জুয়ারা বেগম জানান, দুর্বৃত্তের ছোড়া এসিডে তাঁদের চোখ-মুখসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ঝলসে যায়। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়ায় ভালো। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ এস এ এম আবদুল ওয়াহেদ, সাতক্ষীরা সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমিনুর ইসলাম ও সাতক্ষীরা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আরিফুর রহমান জানান, তাঁদের বিভিন্ন সামগ্রী ক্রয়ের জন্য তহবিল দেওয়া হয়। এর মধ্য থেকে বিজ্ঞানাগারে ব্যবহারের জন্য এসিড কেনা হয়। এ জন্য লাইসেন্স বা অনুমতিপত্র গ্রহণ করতে হয় এ বিষয় তাঁদের জানা নেই। জেলা প্রশাসক ও জেলা এসিড কন্ট্রোল কাউন্সিলের আহ্বায়ক আবদুস সামাদ জানান, এসিডের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে প্রতি মাসে জাতীয় এসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের সদস্য, পুলিশ, বিডিআর, জুয়েলারি মালিক, ব্যাটারি প্রস্তুতকারক সংস্থা, এনজিও প্রতিনিধি ও সুধী সমাজের নেতাদের নিয়ে সভা করা হয়। এসিডের ব্যবহারও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। যাতে কেউ ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে না পারে। পুলিশ সুপার মো. মনির-উজ-জামান জানান, সাতক্ষীরা জেলায় জমি ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পুলিশসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তত্পরতার কারণে এসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা আগের চেয়ে কমেছে। মানুষও সচেতন হচ্ছে।