ভোলায় হাজার প্রতিষ্ঠান এসিড ব্যবহার করে, অনুমোদন আছে ১৯টির

দেশে এসিড-সন্ত্রাসের ভয়াবহতার দিক থেকে ভোলা জেলার অবস্থান দ্বিতীয়। মাত্র ১৯টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে এসিড ব্যবহারের অনুমতি থাকলেও জেলায় হাজারখানেক ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এসিড ব্যবহার করে। বাকি সব প্রতিষ্ঠানের কোনো অনুমোদনপত্র (লাইসেন্স) নেই। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারি-বেসরকারি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের বিজ্ঞানাগারে এসিড ব্যবহার করলেও তাদের কোনো বৈধতা নেই। আট বছরে এখনো জেলায় জাতীয় এসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল গঠিত হয়নি। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা এসিড লাইসেন্স করতে ফি কমানোর দাবি করছেন। ২০০২ সালের ১৭ মার্চ প্রকাশিত গেজেটের ১ নম্বর আইনের অষ্টম অধ্যায়ে উল্লেখ আছে, লাইসেন্স ব্যতীত এসিডের উত্পাদন, আমদানি, পরিবহন, মজুদ, বিক্রি ও ব্যবহার করা দণ্ডনীয় অপরাধ। যারা লাইসেন্স করবে না ও লাইসেন্সের শর্তগুলো পালন করবে না, তাদের জন্য অনূর্ধ্ব ১০ বছর ও অন্যূন তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং অতিরিক্ত ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, ভোলা সদর উপজেলায় দুই শতাধিক, দৌলতখানে ৮০টি, বোরহানউদ্দিনে ১৩০, লালমোহনে ১১৫, চরফ্যাশনে ১৪০, তজুমদ্দিনে ৭০ ও মনপুরায় ২০টিসহ ৭৫৫টি স্বর্ণ ও ব্যাটারির দোকান আছে। এ ছাড়া দুই শতাধিক মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানাগারে এসিড ব্যবহার করা হয়। অনেক আসবাবের দোকানেও ব্যবহার হয় এসিড। জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের লাইসেন্স শাখা সূত্র জানায়, ভোলায় মোট ১৯টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের এসিড ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবহারের লাইসেন্স আছে। এর মধ্যে রয়েছে ভোলা সদরের ছয়টি স্বর্ণ, একটি ব্যাটারি ও তিনটি অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, চরফ্যাশন পৌর শহরে ছয়টি স্বর্ণের দোকান, দুটি ইলেকট্রনিকসের দোকান এবং বোরহানউদ্দিনে একটি স্বর্ণের দোকান। ভোলা শহর জুয়েলারি সমিতির সাধারণ সম্পাদক দীপক কুমার রায় বলেন, ‘শহরের ছয়টি জুয়েলারির দোকানে স্বর্ণ পরিশোধিত ও স্বর্ণালংকার পলিশ-বার্নিশ করা হয়। দোকানগুলোর লাইসেন্স আছে।’ স্বর্ণের খাদ যাচাই ও স্বর্ণ গলাতে প্রতিটি দোকানে এসিড ব্যবহার হয় এ কথা স্বীকার করে ভেনাস জুয়েলার্সের মালিক পংকজ কুমার ভাওয়াল বলেন, ‘সাধারণত খাদ পরীক্ষা ও স্বর্ণ গলানোর কাজে যে এসিড ব্যবহার হয়। এর সঙ্গে পানি মেশানো হয়। ফলে ওই এসিড আর ক্ষতির পর্যায়ে থাকে না।’ জেলায় প্রায় ১০৫টি ব্যাটারির দোকান থাকলেও ভোলা শহরের দ্বায়রা ব্যাটারি ও চরফ্যাশন শহরে সীমা ইলেকট্রনিকস এবং রায়হান ইলেকট্রনিক ছাড়া আর কোনো দোকানের লাইসেন্স নেই। ভোলা ব্যাটারি মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান জানান, তাঁরা সাধারণত ঢাকার রাজার দেউড়ি ও পাটুয়াটুলী থেকে এসিড সংগ্রহ করেন। ব্যাটারি তৈরির সময় যে সালফিউরিক এসিড ব্যবহার হয়, সেটি বিপজ্জনক। তবে আজকাল ভোলায় ব্যাটারি তেমন তৈরি হচ্ছে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তৈরি ব্যাটারিই বেশি চলে। যারা চার্জ দেয়, তারা ব্যাটারিতে পানি ব্যবহার করে। এসব কারণে তারা লাইসেন্স করছে না। ভোলা সরকারি বালক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রাণগোপাল দে বলেন, ‘ভোলা সরকারি স্কুল ব্রিটিশ আমলে নির্মিত। লাইসেন্স হলে সে সময়ই হয়েছে। আদৌ হয়েছে কি না আমার জানা নেই।’ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোকাম্মেল হক বলেন, বিজ্ঞানাগারে এসিড ব্যবহারের জন্য লাইসেন্স করতে হয়, এ বিষয়টি তাঁরও জানা ছিল না। তবে বিজ্ঞান বিভাগ অনুমোদন দেয় এবং তাদের তদারক করে শিক্ষা বোর্ড। তারাই এটা দেখভাল করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো লাইসেন্সের আওতায় আসবে। যে কারণে এসিড লাইসেন্স হচ্ছে না এসিড সারভাইভরস ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্যমতে, দেশে এসিড-সন্ত্রাসে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ভোলা। কিন্তু এ জেলায় জাতীয় এসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের জেলা কমিটি নেই। ২০০২ সালের ১৭ মার্চ প্রকাশিত গেজেটে উল্লেখ আছে, জেলা পর্যায়ে সাত সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় এসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল গঠন করতে হবে, যার প্রধান হবেন জেলা প্রশাসক। জেলা কমিটির দায়িত্ব হচ্ছে এসিডের উত্পাদন, পরিবহন, মজুদ, বিক্রি, ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত নির্ধারিত নীতিমালা বাস্তবায়ন করা। ভোলা এসিড-সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটির সদস্য ও ভোলা আবৃত্তি সংসদের সভাপতি সামস উল আলম বলেন, ‘প্রশাসনকে বারবার বলা সত্ত্বেও তারা জাতীয় এসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল কমিটি গঠন করেনি।’ এসিড লাইসেন্স ফি কমানোর দাবি এসিড নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০০৪ লাইসেন্স ফি বিধি ৫-এ বলা হয়েছে, এসিড আমদানির লাইসেন্স ফি এক লাখ টাকা। এসিড উত্পাদন লাইসেন্স ফি এক লাখ ৫০ হাজার টাকা। এসিড বিক্রি লাইসেন্স ফি পাঁচ হাজার টাকা। বাণিজ্যিকভাবে এসিড ব্যবহার লাইসেন্স ফি ২৫ হাজার টাকা এবং সাধারণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে লাইসেন্স ফি (১০ লিটার পর্যন্ত) শিক্ষা ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের জন্য তিন হাজার টাকা; অন্য প্রতিষ্ঠানের জন্য পাঁচ হাজার টাকা। ১০ লিটারের ওপরে হলে সাত হাজার টাকা ফি দিতে হবে। এসিড পরিবহনের জন্য লাইসেন্স ফি ১০০ টাকা। বিধি ২৬(৩)-এ বলা আছে, প্রতি অর্থবছরে লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে। নবায়ন ফি মূল লাইসেন্সের শতকরা পাঁচ ভাগ দিতে হবে। এসিড ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীরা বলছেন, লাইসেন্স ফি কমানো দরকার। ভোলা সদর রোডের জয়ন্তী জুয়েলার্সের পরিচালক মৃদুল দে বলেন, ভোলার স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা খুব বড় ব্যবসায়ী নন। এঁদের পুঁজি খুব সামান্য। এসিড ব্যবহার ও বিক্রির জন্য যে ফি ধার্য করা হয়েছে, তা খুব বেশি হয়ে গেছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, ‘এসিড ব্যবহার করলে লাইসেন্স করতে হবে, সেটা দুর্বল হোক আর শক্তিশালী হোক। কারণ ব্যবসায়ীরা তো ব্যবসা করছেন। জেলা প্রশাসক যদি ভ্রাম্যমাণ আদালত নামান তবে সব ব্যবসায়ীর কাছে যাওয়া সম্ভব নয়। নিজ উদ্যোগে ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স করা উচিত।’ জেলা প্রশাসক মো. মেসবাহুল ইসলাম বলেন, শিগগিরই জাতীয় এসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল কমিটি গঠন করা হবে। এসিড ব্যবহারকারীদেরও লাইসেন্সের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।