শুধু প্রশিক্ষণই নয়, চাকরির ব্যবস্থা করেছে পারসোনা

সমাজে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন ২৪ জন নারী ঢাকার পারসোনা হেয়ার অ্যান্ড বিউটি কেয়ারে রূপচর্চা বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণে অংশ নেন। মাসব্যাপী এই রূপচর্চা প্রশিক্ষণে এসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিলের উদ্যোগে ছয়জন এসিডদগ্ধ নারীও অংশ নেন। তাঁরা হলেন সাতক্ষীরার নূরজাহান ও নাজমা, মানিকগঞ্জের রূপালী, সিরাজগঞ্জের শোভা, শেরপুরের রূপালী ও কুড়িগ্রামের মিনারা বেগম। ঢাকায় এই ছয় এসিডদগ্ধ নারীর আবাসনের ব্যবস্থা করেছিল এসিড সারভাইভরস নেটওয়ার্ক। ইতিমধ্যে অসহায় নারীদের রূপচর্চা বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। এ উপলক্ষে ১ জুলাই দুপুরে রাজধানীর লালমাটিয়ায় পারসোনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সমাপনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। প্রশিক্ষণার্থীরা ছাড়াও পারসোনার বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা এতে উপস্থিত ছিলেন। পারসোনা হেয়ার অ্যান্ড বিউটি কেয়ার লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কানিজ আলমাস খান বলেন, ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সমাজে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার নারীদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমাদের এ প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। শুধু প্রশিক্ষণ দিয়েই শেষ নয়, সবার চাকরির ব্যবস্থাও করেছে পারসোনা।’ কুড়িগ্রাম থেকে আসা প্রশিক্ষণার্থী মিনারা বেগম বলেন, ‘এখানে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর থেকে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। বিনা পয়সায় প্রশিক্ষণ, তারপর চাকরি নিশ্চিত। নিজেকে আর সমাজের বোঝা বলে মনে হয় না। এখন পরিবারের জন্যও কিছু করতে পারব।’ সিরাজগঞ্জের শোভা বলেন, ‘বিশ্বমানের এ ধরনের প্রশিক্ষণ নিতে বাইরে ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা খরচ হতো। আমাদের এক টাকাও খরচ হয়নি; বরং প্রশিক্ষণের পোশাক, খাবার ও ভাতা পেয়েছি।’ এসিডদগ্ধ শেরপুরের রূপালী বলেন, ‘এসিডে দগ্ধ হয়ে অন্যদের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিলাম না। এ প্রশিক্ষণে রূপচর্চার পাশাপশি মানুষের সঙ্গে কথা বলা, আচরণ ও ব্যবহার শিখেছি। এতে আমাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।’ প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন ব্যাংকক থেকে আসা পারসোনা বিউটি কেয়ারের পরামর্শক সুপাক থাইপায়াকোসাই, দোভাষী নীপা ও স্থানীয় প্রশিক্ষক লিপ্তি, বানিকা, রূপালী ও আমেনা। প্রশিক্ষণে আচরণ, ব্যবহার, শরীরচর্চা, গ্রাহকসেবা (কাস্টমার কেয়ার), সহায়ক যন্ত্রপাতির সঙ্গে পরিচয় ও ব্যবহারবিধিসহ হাত, পা, চুল ও শরীরের যত্নের ওপর তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক শেখানো হয়। রংপুর থেকে আসা কলি বলেন, ‘কোনো ভুল করলে শাস্তি হিসেবে গান গাইতে হতো অথবা নাচতে হতো। ব্যতিক্রমী এ শাস্তি আমাদের খুব ভালো লেগেছে।’ সমাপনী অনুষ্ঠানে মিনারা স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কোরাস গানে সবাই অংশ নেন। প্রশিক্ষক সুপাক থাইপায়াকোসাই বলেন, ‘অন্য মেয়েদের তুলনায় এদের যে আগ্রহ ও ইচ্ছা দেখেছি, তাতে অল্পসময়ে তারা খুব ভালো করেছে। তাদের ব্যাপারে আমি আশাবাদী।’ বিবি মরিয়ম, খাদিজা, ফারজানা, রূপালী, আসমা, রুমি, রিমা, পাপিয়া, আকতার, জেসমিন, নূরজাহান, নূরবানু, মিনারা, স্বাতী, কলি, শারমিন, ইতি, সালমা, রিমি, হ্যাপী, নাজমা, শোভা, রূপালী ও মিনারা প্রশিক্ষণে অংশ নেন। এর আগে ২০০৬ সালে এসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিলের উদ্যোগে ঢাকার পারসোনা হেয়ার অ্যান্ড বিউটি কেয়ারে চার এসিডদগ্ধ নারীকে বিউটিফিকেশনের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শারীরিক ও ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে তিন নারী প্রশিক্ষণ না নিয়ে বাড়ি চলে যান। টিকে থাকেন শুধু একজন। সঙ্গীরা চলে যাওয়ায় প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন তিনি। পারসোনা বিউটি হেয়ার অ্যান্ড কেয়ার লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রথম আলো সহায়ক তহবিলের উপদেষ্টা কানিজ আলমাস খান তাঁকে উত্সাহ দেন। এসিডদগ্ধ বলে সহানুভূতি নয়, বরং কাজের মাধ্যমে নিজের একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন এই নারী। প্রশিক্ষণ শেষে পারসোনায় চাকরি পান। কর্মীদের মধ্যে তিনি ভালো করেছেন। শুনুন তাহলে তাঁর কথা। একজন শাবানা বিয়ে কী জিনিস, তা বোঝার বয়স হয়নি। মাত্র ১২ বছর বয়সে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালে এক ফুফাতো ভাই মনিরুজ্জামান তাঁকে জোর করে বিয়ে করে। চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে বাবা-মা নাম রেখেছিলেন শাবানা। কুড়িগ্রামের ঘুঘুরহাটের অনন্তপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি। বিয়ের পর স্বামী যৌতুক চায় ৪০ হাজার টাকা। দরিদ্র বাবা কোত্থেকে দেবেন এই টাকা। যৌতুকের টাকা না পেয়ে প্রতিদিন তাঁর স্বামী ঝগড়া করত। তাঁকে মারধর করেছে অনেক। অথচ বিয়ের সময় মনির যৌতুক নেবে না বলেছিল। এর প্রতিকার চেয়ে শাবানার বাবা ২০ আগস্ট গ্রাম্য সালিস ডাকেন। সালিসে শাবানার পক্ষে রায় হয়। শাবানা আবার স্বামীর বাড়ি চলে যান। শাবানা বললেন, ‘সালিসের চার দিন পর ২০০৩ সালের ২৪ আগস্ট রাত আটটার দিকে ভাত খাওয়ার আগে ঘরের বাইরে টিউবওয়েল থেকে পানি আনতে যাই। ফেরার পথে স্বামী ও তার দুই চাচা আমার হাত ধরে কী যেন পানির মতো গায়ে ছুড়ে মারলে চিত্কার করে উঠি। লোকজন আমাকে পানি দেয়। গ্রামের চৌকিদার বলেন, পানির মতো এটি ছিল এসিড। সৌভাগ্য যে মুখে এসিড পড়েনি। কিন্তু শরীরের বিভিন্ন অংশ এসিডে ঝলসে যায়। উন্নত চিকিত্সার জন্য চার দিন পর আমাকে ঢাকায় আনা হয়। দুই চাচাশ্বশুরকে আসামি করে মামলা হয়। তাঁরা খালাস পেয়ে যান। তিন মাস পর নতুন করে মামলা হয়। ওই মামলায় মনিরুজ্জামানের সাত বছরের জেল হয়।’ শাবানা আরও বলেন, “জেলে যাওয়ার আগে স্বামী বলে, ‘এক আসামির দুইবার ফাঁসি হয় না, সাত বছর পরে ফিরে আসি তোকে দেখে নিব।’ এরপর শুরু হয় নতুন জীবন। এসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিলের উদ্যোগে পারসোনা বিউটি পারলারে হেয়ার ট্রিটমেন্ট, ফেশিয়াল ও বিউটিফিকেশনের ওপর ছয় মাস প্রশিক্ষণ নিই। ২০০৭ সাল থেকে পারসোনায় চাকরি করছি।” এসিড সারভাইভরস নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী নূরুন্নাহার বলেন, শাবানার মতো অন্য এসিডদগ্ধ নারীরাও এগিয়ে যাবেন। মাথা উঁচু করে বাঁচবেন।