বিদ্যালয় বদলে দিচ্ছে আদিবাসী গ্রামটিকে

প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আদিবাসী শিক্ষার্থীরা
প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আদিবাসী শিক্ষার্থীরা

আগের দুই বছরের মতো এবারও প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় শতভাগ পাস করেছে বাবুডাইং আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এবার পাস করেছে ১৯ জন। এর মধ্যে ১৩ জনই মেয়ে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বরেন্দ্রভূমির গহিনে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র কোল আদিবাসীদের গ্রামের বিদ্যালয়টি এখন পরিচালিত হচ্ছে প্রথম আলো ট্রাস্টের সহায়তায়।
বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও দিনাজপুর জেলায় বসবাসরত কোলদের সংখ্যা দুই থেকে আড়াই হাজারের মতো। কোলরা তাই রসিকতা করে বলে থাকেন, ‘বাবুডাইং হচ্ছে বাংলাদেশে কোলদের রাজধানী।’ ২৫ কিলোমিটার দূরে নিজ উপজেলা গোদাগাড়ীর সঙ্গে সরাসরি নেই কোনো সড়ক যোগাযোগ। তাই চলাচল তাদের ১৪ কিলোমিটার দূরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের সঙ্গে। সাত বছর আগেও ‘স্কুল’ বা ‘বিদ্যালয়’ শব্দটির সঙ্গে এ গ্রামের শিশুদের ছিল না কোনো পরিচয়। গরু-ছাগল চরিয়ে, ধান কুড়িয়ে, বাবা-মায়ের ফুটফরমাশ খেটেই দিন কাটত তাদের। তাদের শিক্ষাবঞ্চনা নিয়ে ২০০৭ সালে প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয় প্রতিবেদন। এ প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ওই বছরই প্রতিষ্ঠিত হয় বাবুডাইং আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২০০৯ সালে প্রথম আলো ট্রাস্টের সহায়তায় মাটির দেয়ালের ওপর ঢেউটিনের ছাউনির এক শ্রেণীকক্ষও তৈরি হয়। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে বিদ্যালয় পরিচালনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। ট্রাস্টের সহায়তায় চলছে চারজন শিক্ষকের বেতন ও বিদ্যালয় পরিচালনার আনুষঙ্গিক খরচ। এতে সামিট গ্রুপ সহায়তা করছে।
‘হামরাকে সবাই ধাঙড়-বুনা ও জংলি বুলে হেলা করতক। এখুন আর বুলে না। হামার এক বেটা এবার গাঁয়ের ইশকুল থাকি ফাইব পাস কোরেছে। আগের বছর আর এক বেটা। তার আগের বছর এক বেটি। হামার বাড়ি থাকি এখুন এক বোহিনের (বোন) পিছে পিছে দু ভাই হাই ইশকুলে যাইছে। এখন আর কেহু বুলতে পারবে না হামরা জঙ্গলি। অ্যার থাকে সুখের কী আছে জীবনে!’ এভাবেই প্রথম আলোর কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বাবুডাইং আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এবার সমাপনী পাস জয়চান্দ হাসদার পিতা মানিক হাসদা। এই বিদ্যালয় থেকে পাস করা মেয়ে পার্বতী হাসদা অষ্টম শ্রেণীতে, আর এক ছেলে সোমচান্দ হাসদা পড়ে সপ্তম শ্রেণীতে দূরের উচ্চবিদ্যালয়ে। প্রায় একই অনুভূতি প্রকাশ করেন সোহেল মার্ডির বাবা মোহন মার্ডি। এই বিদ্যালয় থেকে পাস করা তাঁর এক মেয়ে পড়ে সপ্তম শ্রেণীতে।
বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সুরেন টুডুর ছেলে প্রশান্ত টুডুও এবার সমাপনী পাস করেছে। এই বিদ্যালয় থেকে পাস করা তাঁর মেয়ে শ্যামলী টুডু পড়ে অষ্টম শ্রেণীতে। তিনি জানান, বিদ্যালয়টি না হলে তিনি এত দিন নানা হয়ে যেতেন। শুধু তাই নয়, পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার উপযোগী মেয়েদের অধিকাংশেরই বিয়ে হয়ে যেত। এর হাত থেকে বেঁচেছে বিদ্যালয়ে পড়া মেয়েরা। এখন তিনি মেয়ের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখেন। তাঁর মতো স্বপ্ন দেখছেন বিদ্যালয়ে পড়া অন্য মেয়েদের বাবারাও। গ্রাম থেকে দল বেঁধে ছেলেমেয়েদের উচ্চবিদ্যালয়ে যাওয়ার ঘটনায় গ্রামের এখন সম্মান বেড়েছে। আশপাশের গ্রামের মানুষ যখন বলে, বাবুডাইং আর আগের মতো নেই, অনেক ভালো হয়েছে, উন্নতি করেছে, তখন মনে মনে গর্ব হয়।
গ্রামের মানুষের আনন্দেরও উপলক্ষ হয়েছে বিদ্যালয়টি। বিদ্যালয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, সরস্বতী পূজা, বার্ষিক খেলাধুলা অনুষ্ঠিত হয়। তখন গ্রামের সব বয়সের নারী-পুরুষ ও শিশু বিদ্যালয়ের মাঠে জড়ো হয়। শিশুদের সঙ্গে ঢোল-মাদল বাজিয়ে মনের আনন্দে নাচ-গান করে।