পদ্মাপারের পাঠশালা

মূল রচনা: গ্রামের তিন দিকে ভারত, এক দিকে পদ্মা নদী। চরখিদিরপুর ও চরতারানগর নামের দুই প্রত্যন্ত গ্রামের দিনবদলের সংগ্রামে নেমেছেন একদল তরুণ

আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, রাজশাহী | তারিখ: ২২-১২-২০১২

গ্রামের নাম চরখিদিরপুর ও চরতারানগর।
গ্রামের তিন দিকে ভারত, এক দিকে পদ্মা নদী। এ নদীই তাদের দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা করে রেখেছে। পদ্মার ভাঙনে পেছনে সরতে সরতে তাদের ঠিকানা এখন একেবারে সীমান্তের কাছে। আবাদি জমি কমে যাওয়ায় তাদের প্রধান পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে গবাদিপশু পালন আর নদীতে মাছ শিকার। এখানকার তরুণেরা মূলত ভারতীয় সীমান্ত পার হয়ে আসা গরু পারাপারের কাজ (রাখালি) করে। অভাবী এ জনপদে প্রায় ১০ হাজার মানুষের বসবাস। এলাকায় আছে দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিন্তু এখান থেকে পাস করা শিশুরা জীবনে বড় হওয়ার কোনো স্বপ্ন দেখতে পারে না। তাদের ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার মতো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হতে তাদের ভারতীয় ভূখণ্ডের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের একটি বিদ্যালয়ে যেতে হয়। অথবা পদ্মা নদী পার হয়ে রাজশাহী শহরে আসতে হয়। দুটোই তাদের পক্ষে খুব কঠিন। এ জন্য পঞ্চম শ্রেণী পাস করার পর অনেক ছেলেকেই বেছে নিতে হয় রাখালির কাজ। বিএসএফের গুলিতে মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে এ কাজ করতে হয় বলে তারা ভালো পারিশ্রমিক পায়। তাদের পরিবার এতেই খুশি থাকে। আর পঞ্চম শ্রেণী পাস করা বহু মেয়েকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শ্বশুরবাড়িতে।
এ দুই গ্রামের দিনবদলের সংগ্রামে নেমেছেন একদল তরুণ। তাঁরা সবাই রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী। তাঁদের একটি সংগঠন রয়েছে। নাম ‘বঞ্চিতি বদল’। তাঁরা খেয়াল করেন চরখিদিরপুর ও তারানগর গ্রামের দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও দুর্গম এলাকা বলে শিক্ষকেরা সাধারণত ওই এলাকায় থাকতে চান না। এ সংগঠনের সদস্যরা পদ্মা নদী পার হয়ে বিদ্যালয় দুটিতে বিকেলবেলায় শিশুদের দ্বিতীয় পালার পাঠদান শুরু করেন। পাশাপাশি এলাকার বয়স্কদের লেখাপড়া শেখানো শুরু করেন। প্রথম প্রথম বয়স্ক লোকজন এতে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তাঁদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তাঁরা ঢোল নিয়ে যেতেন। গানের আসর বসাতেন। এতে করে আস্তে আস্তে বয়স্ক লোকজন তাঁদের কথামতো পড়তে শুরু করেন। একসময় তাঁরা চিন্তা করেন বয়স্ক মানুষের চেয়ে শিশুদের সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই তাঁরা প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরোনো শিশুদের নিয়ে কাজ শুরু করার কথা ভাবেন।

‘আমি এখন ক্লাস সিক্সে!’
চরখিদিরপুর ও তারানগর থেকে ভারতীয় সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশের যে বিদ্যালয়টিতে যাওয়া যায়, তার নাম চরমাঝাড়দিয়াড় নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়। বঞ্চিতি বদলের সদস্যরা ওই বিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁরা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে খিদিরপুর ও তারানগরের সমস্যাটা বোঝাতে সক্ষম হন। কথা হয় ওই দুই গ্রামের শিশুদের নাম নিবন্ধন হবে এই বিদ্যালয়ে আর তাদের পাঠদান হবে খিদিরপুর গ্রামে। যেই কথা সেই কাজ। গেল বছরের ঘটনা। বঞ্চিতি বদলের কথা আগেই শুনেছিলাম। যেদিন শুনলাম তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ওই এলাকায় ষষ্ঠ শ্রেণী চালু করতে যাচ্ছে, সঙ্গী হওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। ষষ্ঠ শ্রেণী উদ্বোধনের দিন বঞ্চিতি বদলের সদস্যদের নিয়ে রাজশাহী শহর থেকে রওনা দিই। নৌকায় ছোট নদী পার হয়ে তারপর ধু ধু বালুচর। বালুতে পা বসে যায়। হাঁটতে হাঁটতে পা ধরে আসে। এরপর আরেক সমস্যা, নরম মাটি। সদ্য পানি নেমে গেছে। জুতা আটকে যাচ্ছে। আর পা চলতে চায় না। চরের অর্ধেক পথ পার হয়ে আবার বিপদ। এবার একটু পানি। নৌকাও নেই। ভেলাও নেই। সেই পা-ই ভরসা। জুতা খুলে প্যান্ট গুটিয়ে নামতে হলো পানিতে। সঙ্গে ছিলেন রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক। বঞ্চিতি বদলের অন্যতম উদ্যোক্তা মুরাদুজ্জামান তাঁকে কাঁধে করেই পার করলেন। সামনে বড় নদী। অনেক অপেক্ষার পর এল খেয়া নৌকা। এই নৌকায় মূলত ভারত থেকে নিয়ে আসা গরু পারাপারের কাজ হয়। নৌকার পাটাতনজুড়ে গরুর গোবর মাখা খড় বিছানো। গো-মূত্রের গন্ধে টেকা দায়। মুরাদুজ্জামান বলছিলেন, ফেরার সময় কখনো কখনো তাঁদের গরুর গলা ধরে ফিরতে হয়। শিংয়ের গুঁতাও খেয়েছেন অনেকবার।
নৌকা থেকে নেমে আবার হাঁটা। অবশেষে পাওয়া গেল চরখিদিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সব আয়োজন সারা, কিন্তু বই আনতে হবে মাঝাড়দিয়াড় নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে। ভারতের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। কে যাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।
আমজাদ হোসেন নামের একজন প্রবীণ সবাইকে অবাক করে দিয়ে ছুটে এলেন। তাঁর আগ্রহের কারণ জানা গেল পরে। ষষ্ঠ শ্রেণী খোলা না হলে তাঁর ছোট মেয়েটাকে তখনই বিয়ে দিতে হবে। আমজাদ হোসেন বললেন, ‘এইটুকু মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাইয়া কী করবে। আমহারে এলাকার যে পরিবেশ, বিহে না দিয়ে ঘরে রাখাও উপায় নাই।’ সেদিন ওই সংগঠনের সদস্য ছাড়াও যাঁরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ক্লাস উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন তাঁরা অনেকেই বৃদ্ধ আমজাদ হোসেনকে বই মাথায় নিয়ে আসতে দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। এভাবেই সেদিন খিদিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে শুরু হয় ষষ্ঠ শ্রেণীর ক্লাস।

চরের বুকে আশার আলো
সংগঠনের উদ্যোক্তা মুরাদুজ্জামান রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়ার সময় এই সেবামূলক কাজের জন্য সদস্য সংগ্রহ শুরু করেন। সে সময় তিনি ২০০ ছাত্রের সাড়া পান। কিন্তু কাজ শুরু করার পরে একে একে সদস্যরা ঝরে যেতে থাকেন। এখন তাঁর সংগঠনের পরীক্ষিত ৩৫ জন সদস্য রয়েছেন। প্রতিবছর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু হলেই তিনি সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু করেন। যাঁরা পাস করে চলে যান; নতুনেরা তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করেন।
এ বছরের শুরুতে সেই ষষ্ঠ শ্রেণীর শিশুরা সপ্তম শ্রেণীতে উঠেছে। প্রথম দলের পর ষষ্ঠ শ্রেণী পড়ুয়া শিশুদের দ্বিতীয় দলটিও পড়া শুরু করেছে।
কিন্তু এর মধ্যে দেখা দেয় বসার জায়গার সংকট। সংগঠনের সদস্যরা ছুটে যান রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কাছে।
জেলা প্রশাসক আবদুল হান্নান সেখানে একটি বিদ্যালয় ভবন তৈরি করে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। তিনি রাজশাহীতে কর্মরত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতি সহযোগিতার জন্য আহ্বান জানান। তাঁর উৎসাহে গত জানুয়ারি মাস থেকে এ বিদ্যালয়টি স্থাপনের জন্য পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজ্জাকুল ইসলাম প্রাণান্ত ছোটাছুটি করেন। গত ১৫ সেপ্টেম্বর নতুন ঘরের উদ্বোধনের সময় বিদ্যালয়ের শিশুদের খাতা, কলম, পোশাক ও তিন মাসের টিফিন একসঙ্গে দেওয়া হয়। এতে পবা উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে হরিয়ান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি), বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশনও সহযোগিতা দেয়।
বিদ্যালয়ে নতুন শ্রেণীকক্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সেই আমজাদ হোসেন সামনে বেঞ্চিতে বসা ছিলেন। ভারতের সীমান্তের ভেতর দিয়ে বই মাথায় করে নিয়ে আসার কথা শুনে বক্তারা তাঁর প্রশংসা করছিলেন আর বৃদ্ধ আমজাদ শুধু গামছা দিয়ে চোখ মুছছিলেন।
স্থানীয় মানুষের কাছে বঞ্চিতি বদলের তরুণেরা এরই মধ্যে অতি প্রিয় হয়ে উঠেছেন। গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য আবু আহাম্মেদ বলেন, ‘এই সংগঠনের ছেলেরা এ দুই গ্রামের মানুষকে জাগিয়ে দিয়েছেন। এই ছেলেদের কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই। আমরা যে কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। এই ছেলেরা তা সত্যি করে দেখাল।’ তিনি জানান, এই গ্রামের ৯৮ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর। যে শিশুরা পঞ্চম শ্রেণী পাস করেছিল তারাও ঝরে পড়ছিল।
কথা হয় ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী স্বাধীনা খাতুনের সঙ্গে। তার পরনে নতুন স্কুলের পোশাক। স্বাধীনা বলছিল, ‘আমার দুই বোন পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। তারপর পড়ার ইশকুল নাই দেখে বিয়ে হয়ে গেছে। এই ইশকুল না হলে আমারও পড়া হইত না।’
সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সুমাইয়া খাতুনের বড় বোন সাথীও পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। তারপর তাঁর বিয়ে দেওয়া হয়েছে। বড় ভাই সোহেলেরও একই অবস্থা হয়েছে। বিদ্যালয় না হলে তোমার কী হতো জানতে চাইলে সুমাইয়া শুধু মুখ টিপে হাসে, কোনো কথা বলে না।
ছবি: সাহাদাত পারভেজ