চরের নাম প্রথম আলো

চরের নাম প্রথম আলো
কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নামহীন এক চর কীভাবে হয়ে উঠল প্রথম আলোর চর, সেই কাহিনী শোনাচ্ছেন সফি খান
যাত্রাপুর হাটের পূর্ব পাড়ে দাঁড়িয়ে উত্তর দিকে তাকিয়ে চমকে উঠি। ওপারে কাশফুলের ওপর হেলে পড়েছে শরতের নীল আকাশ। সেখানে চক চক করছে সারি সারি টিনের চালা। ঘাটে অপেমান মাঝিদের ইচ্ছে করেই প্রশ্ন করি ‘ওটা কোন চর বাহে’, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর ‘প্রথম আলোর চর।’ কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুরহাট থেকে উত্তরে এবং ঘোগাদহ থেকে পূর্বে দুধকুমোর, গঙ্গাধর নদী ও ব্রহ্মপুত্রের কোল ঘেঁষে পাঁচ বছর আগে জেগে ওঠে এই চর। পাশেই ভারতের আসাম। চরটির দৈর্ঘ্য ২ কিলোমিটার, প্রস্থ ০.৭৮ কিমি। কুড়িগ্রাম শহর থেকে দূরত্ব ২০ কিলোমিটার।
যাত্রাপুর থেকে ছোট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে দুধকুমোর পাড়ি দিয়ে চরে গিয়ে উঠি। চর তো নয় যেন কাশবাগান। ভেতরে গিয়ে চোখ জুড়িয়ে যায়Ñসাদা ফুলের মাঝে সবুজের ছড়াছড়ি। রাখাল বালকরা দলবেঁধে গরু, মহিষ, ছাগল চরাচ্ছে। এক পাশে সারিবদ্ধ টিনের চালা। চালের ওপর লাউ, চালকুমড়ো, শিম, ঝিঙা। বাড়ির পাশেই নানা শাকসবজি তে। উঁচু বাড়ির চারদিকে ফল ও কাঠের গাছ। এসবই প্রথম আলোর চরের আজকের চিত্র। কিছুদিন আগেও কিন্তু অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
প্রথম দিকে চরটি ছিল ধুধু বালুচর। কিছু কিছু স্থানে কাশগাছ হতো। ২০০৪ সালে বন্যায় বরুয়া, রলাকাটা, কালীর আলগা, ঝুনকারচরের বাড়ি ভেঙে গেলে দিশেহারা হয়ে পড়ে ওইসব চরবাসী। পরে বাধ্য হয়ে এ চরে কাশিয়া কেটে বাড়ি তৈরি করে তারা। চরে প্রথম বসতি স্থাপন করেন শিক মোক্তার আহাম্মেদ, জাহেদুল ইসলাম ও মিজানুর রহমান। ওই বছর প্রচুর বাড়ি নদী ভাঙলে ধীরে ধীরে লোকজন এ চরে এসে বসতি গড়ে তোলে। বর্তমানে এখানে প্রায় ১৩০টি পরিবারের ৭৫০ জন বসবাস করেন।
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে একটার পর একটা নদীভাঙা পরিবার চরে এসে বাড়ি করছে, কেউ বাধা দিচ্ছে না। শুধু তাই নয়, বাড়ির আশপাশে জমি পরিষ্কার করে চাষাবাদ করছে, ফসল ফলাচ্ছেÑ কেউ কিছু বলছে না। ফসলের ভাগ চাচ্ছে না। স্থানীয় ইউপিসদস্য লোকমান হোসেন জানান, ৫০-৬০ বছর আগে চরটি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। কয়েক বছর আগে চরটি আবার জেগে ওঠে। যাদের জমি অনেক দূরে থাকে তারা। অনেকে জানেও না, এখানে তাদের জমি আছে। যারা জমির কথা জেনে গেছে তারা এসে বলে গেছে অসুবিধা নেই, তোমরা থাকো ফসল হলে ভাগ দিও।

যেভাবে নাম হলো প্রথম আলোর চর
চরের বাসিন্দা আবু বক্কর, ফজলার রহমান ও আছুরউদ্দিন জানান, চরটি নতুন হওয়ার প্রথম দিকে কোনো ইউনিয়নভুক্ত ছিল না। জনপ্রতিনিধি কিংবা সরকারি-বেসরকারি এনজিও-ও কোনো খোঁজ নেয়নি। আর চরটি তিনটি ইউনিয়নের সীমান্তে হওয়ায় প্রথমে কোনো ইউনিয়নই এর দায়িত্ব নিতে চায়নি। যাত্রাপুর ইউনিয়নের ধারণা, এটি ঘোগাদহ ইউনিয়নে পড়েছে। ঘোগাদহ ইউনিয়ন মনে করত, যাত্রাপুর ইউনিয়নের মধ্যে। অপরদিকে নুন খাওয়া ইউনিয়ন পরিষদ ধরেই নিয়েছে চরটি তাদের ভেতরে নয়। ফলে কেউ তাদের খোঁজ রাখত না। ২০০৩ সালে প্রথম আলোর উপসম্পাদক ও লেখক আনিসুল হক মঙ্গার খোঁজখবর নিতে গিয়ে এই চরে আসেন। সেই সময় মঙ্গাপীড়িত চরের মানুষদের কিছু ত্রাণ সাহায্য দেয় প্রথম আলো বন্ধুসভা। সেই শুরু। আস্তে আস্তে ‘কুড়িগ্রাম বন্ধুসভা’র ছেলেমেয়েরা চরবাসীর আরো কাছাকাছি চলে আসে। এ অঞ্চলে কৃষকদের ফসলহানির সময় চারা দেওয়া থেকে শুরু করে শীতের সময় গরম কাপড়, মঙ্গার সময় খাদ্য, নদীভাঙা মানুষের জন্য টিনের ঘর, রোজা-ঈদে সেমাই বণ্টন করে। ধীরে ধীরে তাদের বিশ্বাস জš§ায় এরাই আমাদের প্রকৃত বন্ধু। আর যেকোনো সমস্যায় চরবাসীর ঠিকানা হয়ে ওঠে কুড়িগ্রাম প্রথম আলো অফিস।
২০০৪ সালের ১৫ নভেম্বর ঈদুল ফিতর। সকালে নামাজ পড়ে আমি ও প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্য মোখলেছুর রহমান চরে যাই। উদ্দেশ্য গরু কোরবানি দেওয়া। শিক মোক্তার আহাম্মেদের বাড়ির সামনে চরবাসী হাজির। কোরবানির জন্য গরু প্রস্তুত, হঠাৎ জাহিদুল ইসলাম উপস্থিত লোকজনের উদ্দেশে বলেন, আমরা এই চরে বসবাস করি কিন্তু নাম নেই। মানুষ জিজ্ঞেস করে বাড়ি কোথায়? উত্তর দিই, নদীর ওপার। চরের একটা নাম থাকা উচিত। আমি যদি একটা নাম দিই মানবেন? সঙ্গে সঙ্গে সবাই বলে মানব। তিনি বলেন, প্রথম আলোর বন্ধুসভার ছেলেমেয়েরা আমাদের বিপদে-আপদে পাশে এসে দাঁড়ান। বিনিময়ে কিছু চান না তারা। আমরা খুশি হয়ে আজ থেকে চরের নাম দিলাম প্রথম আলোর চর। মহা আনন্দে সবাই চিৎকার করে বলতে থাকে ‘প্রথম আলোর চর, প্রথম আলোর চর’।
প্রথম দিকে চরে ছিল শুধু বালু আর বালু আর কাশবন। বিভিন্ন চর থেকে নদীভাঙা মানুষ এসে কাশবন কেটে বসতি স্থাপন করে। প্রতিটি বাড়িতে ছিল খড়ের চালা। টিউবওয়েল না থাকায় নদীর পানি খেত আর খোলা স্থানে পায়খানা করত। রোগবালাই ছিল নিত্যসঙ্গী। পরিবার পরিকল্পনার বালাই ছিল না। ঘরে ঘরে ছয়-সাতটি করে বাচ্চা। স্কুল নেই, জানতো না সবজি চাষ ও গাছ লাগানোর উপকারিতা। এই অবস্থার মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক করে উল্লিখিত বিষয় সম্পর্কে চরবাসীকে সচেতন করা হয়। তারা ঘোষণা করে, আমরা রিলিফ চাই না, কাজ চাই। একটি স্কুল চাই। জোরেশোরে কাজ শুরু হয়ে যায়। প্রথম আলো কুড়িগ্রাম অফিস থেকে সবজি বীজ ও ওষুধ দেওয়া হয়। রোগীকে চর থেকে নিয়ে এসে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ কিনে দেওয়া হয়। চর থেকে শহরে এলেই জোর করে গাছের চারা কিনে দেওয়া হয়। এরপর স্থানীয় এনজিও ‘জীবিকা’র পরিচালক মানিক চৌধুরীকে বুঝিয়ে চরে প্রতিটি বাড়িতে টিনের ঘর ও বন্যার হাত থেকে বাঁচাতে প্রতিটি বাড়ি ৫ ফিট উঁচু করে দেওয়া হয়। বিশুদ্ধ পানির জন্য পাঁচটি টিউবওয়েল দেওয়া হয়। ইচ্ছে ও চেষ্টা থাকলে মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেÑপ্রথম আলোর চরের মানুষ সে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। নদীভাঙা নিঃস্ব-অসহায় মানুষগুলো বাঁচতে শিখেছে। সাবলম্বি হচ্ছে। বর্তমান চরে পা দিলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রতিটি বসতবাড়িতে বিভিন্ন গাছপালা ও সবজি তে; ঘরের চালে লাউ, কুমড়া, চালকুমড়োর গাছ। কাউন, চিনাবাদাম, সরিষা ও ধান আবাদ হচ্ছে। অনেক পরিবারের সদস্য বাড়তি আয়ের জন্য জেলার বাইরে গেছেন কাজে। এই চরে একজন মাত্র বিএ, তিনি চরে থাকেন না। এইচএসসি ও এসএসসি পাস মাত্র একজন, স্কুলপড়–য়া ছাত্র আছে দুজন। তবে চরে কোনো স্কুল নেই। ৪ কিমি দূরে একটি স্কুল রয়েছে, নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হয় বলে কেউ যায় না। প্রথম আলোর সহযোগিতায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া চলছে।
সম্প্রতি চরে গিয়ে দেখা যায় কাশফুলের গাছ দিয়ে ঝাড়– তৈরি করছে ছয়ফুলের স্ত্রী অবিরণ বেওয়া (৭০)। তিনি বলেন, ৫০ বছর আগে এই চর ছাড়ি গেছি। চরটি জেগে উঠলে আবার আসি। নিজের জায়গায় আসতে পেরে খুব খুশি। এ জায়গার নাম কীÑজিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘ক্যা প্রথম আলোর চর।’ গৃহস্থ মঈনুদ্দিন বলেন, আমরা যখন এই চরে আসি তখন শুধু বালু আর কাশিয়া। কোনো চাষাবাদ হতো না। বর্তমানে অনেক পরিবর্তন হয়েছেÑধান, পাট, কাইন, সবজি চাষ হচ্ছে। ১৬ বার বাড়ি ভেঙেছে জামিলা বেগমের (৬৫)। তিনি জানান, গত বছর ঝুনকারচর থেকে এই চরে এসেছেন। বর্তমানে খুব ভালো আছেন। গানজিয়া ধানের চারা লাগাচ্ছেন এক দম্পতিÑএনছের আলী (৫০)-সামর্থ্য বিবি (৩৫)। তারা জানান, অন্যের জমি বর্গা নিয়ে এই চারা লাগাচ্ছেন। কোনো বালা-মছিবত না হলে বছরের ভাত হবে। গরু চরাচ্ছে একদল রাখাল ছেলে। চরে আগে কোনো ঘাস ছিল না। এখন চরে প্রচুর ঘাস। সবার বাড়িতে দুই-চারটা গরু, ছাগল ও ভেড়া আছে। রাখালরা জানায়, স্কুল না থাকায় তারা গরু চরায়।
কথা হয় রুপালি, জোসনা, মোহাম্মদ, মফিজুল, ইমিনুর, পারভীন, রফিকুল, ছাবিনা, হালিম, আলমগীর, আহইল, কাকলসহ অনেক শিশুর সঙ্গে। এদের বয়স ৬-১২ বছরের মধ্যে। কেউ পূর্বের চরে থাকতে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে, এখন স্কুল না থাকায় পড়ে না। তবে স্কুল হলে অবশ্যই তারা স্কুলে যাবে বলে জানায়। কথা হয় চর থেকে দুধ সংগ্রহকারী দুরগত আলী (৪০) গোয়ালার সঙ্গে। তিনি প্রতিদিন খুব সকালে চরে এসে দুধ সংগ্রহ করে নদীর ওপারে হাটে নিয়ে বিক্রি করেন। তিনি বলেন, প্রতিদিন ৪০-৪৫টি বাড়ি থেকে ৩০-৩৫ কেজি কিনে নিয়ে যাই। এই চরের এখন ভালো উন্নতি হয়েছে।
প্রথম আলোর চরটি এখন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নে পড়েছে। স্থানীয় মেম্বার লোকমান হোসেন চর এবং চরের মানুষের উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, নামহীন এই চরটির নাম প্রথম আলো হওয়ায় আমরা খুব খুশি। এ জন্য তিনি প্রথম আলো কর্তৃপ ও বন্ধুসভার সদস্যদের কৃতজ্ঞতা জানান। বলেন, আমার একটি চোখ সারা ওয়ার্ডের দিকে আর একটি চোখ প্রথম আলোর চরের দিকে। এই চরটিকে আমরা মডেল চর হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। ঘোগাদাহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল মালেক কথা প্রসঙ্গে বলেন, আমার ইউনিয়নে প্রথম আলোর চর পড়ায় আমি গর্বিত।
সূর্য যখন চলে আসে মাথার ওপরে তখন ফিরে আসার পালা। কাশবনের মাঝ দিয়ে হেঁটে চলে আসি দুধকুমোর নদীর পারে। ছোট ডিঙ্গি ভাসিয়ে দেয় মাঝি। স্রোতের টানে উজানের ঘাটের দিকে এগোতে থাকি। ভাবনা আসে প্রকৃতি নিজের হাতে অপরূপ সৌন্দর্যে চরটি গড়ে তুলেছে। এটাই এক দিন আদর্শ চর হিসেবে গড়ে উঠবে। এখান থেকে আলো ছড়াবে চর থেকে চরে। সেই স্বপ্ন দেখে বন্ধুসভার সদস্যরা।