নতুন ঘর পেলেন হামিদা বেওয়া

প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে বন্ধুসভার ব্যবস্থাপনায় দেশের কয়েকটি জেলায় গতকাল বন্যার্ত মানুষের পুনর্বাসনের জন্য ঢেউটিন, সেলাই মেশিন, বসবাসের ঘর, ছাগল, সার ও শস্যবীজ বিতরণ করা হয়েছে। প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, কার্যালয় ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:

দেশের বিভিন্ন স্থানে গতকাল বন্যার্তদের নতুন ঘর, সেলাই মেশিন, ছাগল ও শস্যবীজ দেওয়া হয়। গাইবান্ধা আসাদুজ্জামান গার্লস স্কুল ও কলেজ মাঠে দরিদ্র ও বন্যার্ত আটজন নারীকে দেওয়া হলো পা-চালিত সেলাই মেশিন l প্রথম আলো
দেশের বিভিন্ন স্থানে গতকাল বন্যার্তদের নতুন ঘর, সেলাই মেশিন, ছাগল ও শস্যবীজ দেওয়া হয়। গাইবান্ধা আসাদুজ্জামান গার্লস স্কুল ও কলেজ মাঠে দরিদ্র ও বন্যার্ত আটজন নারীকে দেওয়া হলো পা-চালিত সেলাই মেশিন l প্রথম আলো

বিরামপুর (দিনাজপুর)
স্বামী নেই। ছেলেমেয়েরা কেউ কাছে থাকে না। শুধুই প্রতিবন্ধী মেয়ে আকলিমা (৩০) রয়ে গেছেন মা হামিদা বেওয়ার সঙ্গে। সেই সঙ্গে সম্বল ছিল শুধু মাথা গোঁজার প্রায় তিন শতক জমির ওপর ভাঙাচোরা মাটির একটি ঘর।
এবারের বন্যায় ভেঙে যায় হামিদা বেওয়ার ঘরটি। মা-মেয়েকে আশ্রয় দেন ওই গ্রামের প্রভাষক আবদুস সালাম।
গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে হামিদা বেওয়াকে নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে ‘প্রথম আলো নিবাস’ নামের একটি টিনের ঘর। ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১০ ফুট প্রস্থের ঘরের সঙ্গে দেওয়া হয়েছে একটি কাঠের খাট।
সকাল ১০টায় ইউএনও মো. গোলাম রব্বানী উপস্থিত থেকে হামিদা বেওয়ার হাতে ওই ঘরের চাবি তুলে দেন। ওই সময় উপস্থিত ছিলেন চিরিরবন্দর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোরশেদ উল আলম।
ঘর পেয়ে আবেগাপ্লুত হামিদা বেওয়া বলেন, ‘চেনা নাই জানা নাই হামাক তোরা কেঙ্কেরে খুঁজে বার করলেন বা। ঘরটা ভাঙ্গিবার পর পাগলিটাক নিয়ে কোটে থাকমো, কী করমো সেটাই কূলকিনারা করবা পারছোলো না। আল্লাহ্ তোমার ভালো করুক বা।’
এ সময় ইউএনও গোলাম রব্বানী হামিদা বেওয়ার জন্য দ্রুত বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করার ঘোষণা দেন।
হামিদা বেওয়া ছাড়াও প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে বিরলের ধর্মপুর ইউনিয়নের কামদেবপুর গ্রামের মৃত আবদুল বাতেনের স্ত্রী শেফালী বেওয়ার জন্য আরেকটি ঘর নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে।
এ ছাড়া বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আটটি টিউবওয়েল স্থাপন করা হচ্ছে।

শরীয়তপুর
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বিলাসপুর এলাকায় পদ্মা নদীর ভাঙন ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১২টি পরিবারকে একটি করে ছাগল দেওয়া হয়েছে।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বন্ধুসভার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মোতালেব প্রমুখ।
জাজিরার বিলাসপুর মল্লিককান্দি গ্রামের সোনাই বিবি। স্বামী দেলোয়ার হোসেন প্রতিবন্ধী। পদ্মার ভাঙনে বসতবাড়ি ও ফসলি জমি বিলীন হয়ে যায়। পাশের বিলাসপুর সফিকাজীর মোড় এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন।
সোনাই বিবি বলেন, ‘দিনমজুর খেটে সংসার চালাই। প্রথম আলোর দেওয়া ছাগল লালন–পালন করে সংসারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করতে পারব।’

গাইবান্ধা
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর গ্রামের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ও দরিদ্র আটজন নারীকে একটি করে পাচালিত সেলাই মেশিন দেওয়া হয়। গতকাল দুপুরে গাইবান্ধা আসাদুজ্জামান গার্লস স্কুল ও কলেজমাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে নারীদের হাতে মেশিন তুলে দেন কলেজটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ইদ্রিস আলী।
ফুলছড়ি উপজেলার মধ্যউড়িয়া গ্রামের শাহিনুর খাতুনের (২২) বিয়ে হয়নি। বাবা আবদুর রহমান দিনমজুর। দুই বছর আগে সেলাই প্রশিক্ষণ নেন। অন্যের টেইলার্সে দৈনিক হাজিরায় কাজ করেন। শাহিনুর বললেন, ‘বিয়ের জন্য অনেক টাকা লাগে। বাবার সেই সামর্থ্য নেই। আপনারা সেলাই মেশিন দিয়ে বাবার দায়িত্ব পালন করলেন। মেশিনের আয় দিয়ে বাবাকে সাহায্য করতে পারব।’
এ সময় উপস্থিত ছিলেন গাইবান্ধা বন্ধুসভার উপদেষ্টা চুনি ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান প্রমুখ।

জামালপুর
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় বন্যাদুর্গত এলাকার দরিদ্র সাতটি পরিবার ঘর তৈরির ঢেউটিন পেল। গতকাল দুপুরে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা মাঠে প্রতিটি পরিবারকে দুই বান্ডিল করে ঢেউটিন দেওয়া হয়।
সারিয়াবাড়ি গ্রামের জুয়েল মিয়ার দুটো পা নেই। হুইলচেয়ারে করে এসেছিলেন ঢেউটিন নিতে। জুয়েল বলছিলেন, ‘আমার ঘর নাই, বাপের ঘরে থাকি। আমার বউ আমার মতোই প্রতিবন্ধী। থাকনের কোনো জাগা নাই। আপনাগো টিনগুলা দিয়া এখন ঘর তুলবার পারুম।’
ঢেউটিন বিতরণের সময় উপস্থিত ছিলেন জামালপুর বন্ধুসভার উপদেষ্টা নাজমুল হাসান, সাধারণ সম্পাদক মেহেদী ফখরুল হাসান প্রমুখ।

গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী)
‘বাপ-দাদার জমি ছিল। নদীতে সব ভাইঙ্গা অহন জমিজাতি কিচ্ছু নাই। মাইনষের জমি সনকরা নিইয়া চাষ কইরা খাই। ধানটান যা বুনছিলাম, তাও বাইস্যায় (বর্ষা) শেষ। অহন আপনাগোর কাছ থেইকা যে বীজ-সার পাইলাম, এটা আমার খুব উপকার দিব।’ কথাগুলো বলছিল গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের দেবগ্রামের বাসিন্দা, নদীভাঙনে সর্বহারা কৃষক আজিত খাঁ।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে দেবগ্রামের অস্থায়ী ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় দেড় শ কৃষকের মধ্যে সার ও ছয় রকম শাকসবজির বীজ বিতরণ করা হয়।
এ সময় কৃষকদের বীজ বপনের নিয়ম ও যত্ন বিষয়ে বক্তব্য দেন উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা প্রতাপ মণ্ডল ও উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মঞ্জুর রহমান।

তারাগঞ্জ (রংপুর)
নতুন টিনের ঘর। হাতে চাবি। পরনে নতুন শাড়ি। বৃদ্ধা লতিফুন নেছার চোখ স্থির। আনন্দে চকচক করছিল। আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না। চোখের কোণে জমে থাকা পানি টুপ করে পড়ে। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে নিজেকে কিছুটা সামলিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, ‘জেবনে পোরথোম নয়া ঘরোত শুতি থাকিম। স্বামীর বাড়িত যখন আচচি তখনো বুইড়া ঘর। ৩০ বছর আগোত স্বামী মরচে। এ্যার–অর বাড়িত কাম করি জেবন চলাচু। এ্যালা আর শরীল চলে না। ভিক (ভিক্ষা) করি খাও। এবার বানোত মোর ঘরটা ভাঙ্গিয়া পড়ি গেইচে। খুব কষ্ট হছিল। আল্লাহ তোমার ভালো করবে বাবা।’ লতিফুন নেছার (৭৫) বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে।
গত ১২ আগস্ট ভারী বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ভেঙে পড়ে তাঁর বসতি একমাত্র কুঁড়েঘরটি। এরপর থেকে প্রতিবেশী এক ব্যক্তি অসহায় লতিফুনকে ঠাঁই দিয়েছিলেন তাঁর বাড়ির বারান্দায়। তাঁকে দেওয়া হয়েছে একটি নতুন টিনের ঘর, টিউবওয়েল ও নতুন শাড়ি।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ওই ঘরের চাবি তাঁর হাতে তুলে দেন ইকরচালী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম। এ সময় সঙ্গে ছিলেন তারাগঞ্জ বন্ধুসভার আহ্বায়ক আজহারুল ইসলাম ও সদস্যরা।

সুনামগঞ্জ
সুনামগঞ্জে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলো ট্রাস্টের পক্ষ থেকে দুটি উপজেলার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫৫ জন কৃষককে সার দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক কৃষককে ২৫ কেজি করে ইউরিয়া সার দেওয়া হয়। এই সার তাঁরা ৪৫ শতক আমন জমিতে দিতে পারবেন।
সদর উপজেলার ব্রাহ্মণগাঁও এলাকায় গতকাল দুপুরে সদর ও দোয়ারাবাজার উপজেলার নয়টি গ্রামের ৫৫ জন কৃষকের মধ্যে এই সার বিতরণ করা হয়। সার পেয়ে ব্রাহ্মণগাঁও গ্রামের কৃষক আবদুর রহমান (৫৫) বলেন, ‘গত বৈশাখে হাওরের সব ফসল পানিত তলাইছে। এখন কষ্ট কইরা আমন লাগাইছি। কিন্তু টাকার অভাবে সার দিতাম পারছিলাম না। এই সারে আমরার খুব উপকার অইব।’
সার বিতরণকালে সুনামগঞ্জ বন্ধুসভার সভাপতি মো. রাজু আহমেদ, সহসভাপতি মো. হায়দার আলী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।