হাতে হাঁস, মুখে হাসি

প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে বন্ধুসভার ব্যবস্থাপনায় দেশের কয়েকটি জেলায় গতকাল বন্যার্ত মানুষের পুনর্বাসনের জন্য বসবাসের ঘর, ছাগল, হাঁস, সার ও শস্যবীজ বিতরণ এবং রাস্তা মেরামত করা হয়েছে। প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, আঞ্চলিক কার্যালয় ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:

সিলেটের বালাগঞ্জে ৫০টি বন্যার্ত পরিবারকে গতকাল প্রথম আলো ট্রাস্টের পক্ষ থেকে ১০০টি হাঁস দেওয়া হয় l প্রথম আলো
সিলেটের বালাগঞ্জে ৫০টি বন্যার্ত পরিবারকে গতকাল প্রথম আলো ট্রাস্টের পক্ষ থেকে ১০০টি হাঁস দেওয়া হয় l প্রথম আলো

 বদরগঞ্জ (রংপুর)

ডোবার ধারে রাস্তার ওপরে ছোট্ট একটি কুঁড়েঘর। পাশে আনুমানিক আড়াই বছর বয়সের বস্ত্রহীন দুটি যমজ শিশু রাস্তায় গড়াগড়ি করে কাঁদছিল। ঘোরাঘুরি করছিল অন্য দুটি শিশু। জানা গেল, তারা চারজনেই ভাইবোন। বাবা একরামুল তাদের ফেলে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। মা জয়গুন নেছা ঘরে নেই। চার সন্তানের মুখের খাবার জোগাতে সাতসকালে বেরিয়ে গেছেন। আসবেন সন্ধ্যার পরে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে আসেন ওই শিশুদের নানি রেজিয়া বেগম। জয়গুনের নাম লিখে রেজিয়াকে দেওয়া হয় একটি স্লিপ। এই স্লিপ হাতে গতকাল শুক্রবার বিকেলে এসে জয়গুন নেছা নিয়ে যান একটি ছাগল।

প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার শাহাপুর মাঠে গতকাল বন্যাপীড়িত এমন দুস্থ ১২ জনকে ছাগল দেওয়া হয়েছে। বদরগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হেলাল হোসেন দুস্থদের হাতে ওই ছাগল তুলে দেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন নাগরিক অধিকার সংগঠনের বদরগঞ্জ উপজেলা সভাপতি সিতুয়া দাস ও প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্যরা।

ছাগল হাতে পেয়ে জাহেদা বেগম মহাখুশি। তিনি বলেন, ‘মুই দোয়া করো তোরা দুধভাত খান। তোরাও মোক দোয়া করি দেও। এই একটা ছাগল পুষিয়া বাড়ি ভর্তি ছাগল করিম। আল্লায় চাইলে ছাগলটায় মোক ধনী বানাইবে।’

 সিলেট

দুই হাতে দুটি হাঁস আর মুখে হাসি নিয়ে রোকেয়া বেগম বলছিলেন, এই হাঁসের ডিম ফুটিয়ে তিনি এক পাল হাঁস বানাবেন। সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার বন্যা উপদ্রুত হাওরপারের গ্রামের বাসিন্দা তিনি। গতকাল রোকেয়ার মতো ৫০ জন কিষানির হাতে তুলে দেওয়া হয় দুটি করে হাঁস।

শেফালী মালাকার নামের একজন কিষানি জানালেন, তাঁর ঘরে মুরগি ও হাঁস ছিল। প্রথম দফার বন্যায় সবই ভেসে গেছে। একরকম নিঃস্ব অবস্থায় দুটি করে ডিমওয়ালা হাঁস পেয়ে খুশিমনে জানালেন, ‘আমি গরিব মানুষ, কেউ আমারে দেখে না। আজকে দূর থাকি আইয়া হাঁস দিসো। আমরার মঙ্গল অইব, তোমরারও মঙ্গল চাই।’

বালাগঞ্জ ডিএন মডেল উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে হাঁস বিতরণ করা হয়। এ কার্যক্রমের সূচনা করেন প্রধান শিক্ষক মো. সাইফুল ইসলাম। বিতরণকালে ওই বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক গুলজার আহমদ চৌধুরী, গোবিন্দ চক্রবর্ত্তী, প্রথম আলো সিলেট বন্ধুসভার সভাপতি জেরিন তাসনিমসহ বন্ধুসভার সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

ফরিদপুর

বন্যায় ভেঙে গিয়েছিল শেফালী খাতুনের ঘর। স্বামী ও দুই মেয়েকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেই শেফালী বেগমকে দুই কক্ষের একটি দোচালা টিনের ঘর দেওয়া হলো।

চরভদ্রাসন সদর ইউনিয়নের ফাজিল খাঁ ডাঙ্গি গ্রামে ওই ঘর করে দেওয়া হয়েছে। শেফালী বেগমের স্বামী শেখ জলিল একজন দিনমজুর। শেখ জলিলের আদি বসতবাড়ি ছিল উপজেলা সদরের তমিজ খাঁর ডাঙ্গি গ্রামে। তা ভেঙে যাওয়ায় তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন।

শেফালী বেগমের দুই মেয়ে। সংসারে নিত্য অভাব, তারপরও বহু কষ্টে মেয়েদের পড়ালেখা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন শেফালী বেগম। বড় মেয়ে যূথী চরভদ্রাসন সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। ছোট মেয়ে সখী স্থানীয় মোল্লার ডাঙ্গি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী।

নতুন ঘর পেয়ে খুশিতে আপ্লুত শেফালী বেগম বলেন, ‘বারবার নদীভাঙনের কবলে পড়েছি। ঘরবাড়ি, জমি—সব হারাইয়া একেবারে শেষ হইয়া গেছি। আইজ প্রথম আলো আমাকে একটি সুন্দর ঘর তুইলা দেছে। এই ঘরে স্বামী ও মাইয়াদের নিয়া ঝড়বৃষ্টি, চোর-বাটপারদের হাত থাইকা নিরাপদে থাকতে পারব। আমার ঘরের কষ্ট দূর হইছে।’

রাজবাড়ী

রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার রতনদিয়া ইউনিয়নের হরিণবাড়িয়া বাজার এলাকায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামত করে দেওয়া হচ্ছে।

প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে রাস্তা মেরামত করা দেখে বিস্ময় ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন অনেকেই। স্থানীয় বাসিন্দা নিয়ামত উল্লাহ বলেন, ‘রাস্তাটির বিভিন্ন স্থানে গর্ত হয়েছে। ইট রাস্তা থেকে সরে গেছে। এতে গাড়িতেও চলা যায় না। আমাদের চলাচল করতে খুব সমস্যা হচ্ছিল।’

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাটি হলো হরিণবাড়িয়া বাজার থেকে সাদার চর সড়ক। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রাস্তা মেরামতের কাজ শুরু হয়। সহযোগিতা করেন কালুখালী শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হোসেন, ইউপি সদস্য বিল্লাল মণ্ডল, সাবেক ইউপি সদস্য মোফাজ্জেল হোসেন প্রমুখ।

ধুনট (বগুড়া)

বগুড়ার ধুনট উপজেলায় বন্যায় ফসলহারা প্রান্তিক কৃষক পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য শুক্রবার ধুনট বাজার এলাকায় সার ও বীজ বিতরণ করা হয়েছে।

ধুনট উপজেলার এলাঙ্গী ইউনিয়নের তারাকান্দি, ফকিরপাড়া, নলডাঙ্গা, চালারভিটাসহ পাঁচটি গ্রামের বন্যার পানিতে ফসলহারা ৭০ জন কৃষকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে সার ও বীজ। প্রতিজন কৃষককে এক বিঘা জমিতে ফসল উৎপাদনের জন্য ১০ কেজি টিএসপি, ৫ কেজি এমওপি, ১৫ কেজি ইউরিয়াসহ মোট ৩০ কেজি করে সারের সঙ্গে দেওয়া হয়েছে এক কেজি করে বারি ১৪ জাতের সরিষার বীজ।

সার-বীজ পেয়ে ফকিরপাড়া গ্রামের আফজাল হোসেন বলেন, ‘আমার এক বিঘা জমি। তাও আবার নদীর চরে। ঘরের ভাত খাইবার নাইগা ঐ জমিতে ধানের আবাদ করছিলাম। বানে ধান জাললা খায়া গ্যাছে। এখন ওই জমিতে সরিষার আবাদ করতে আর চিন্তা থাকল না।’

এ সময় উপস্থিত ছিলেন ধুনট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান, ধুনট বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ বিকাশ চন্দ্র সাহা। ধুনট প্রেসক্লাবের সভাপতি রফিকুল আলম, রাঙামাটি আবুল হোসেন জহুরা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মশিউর রহমান, সমাজসেবক আলী, রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।

মাদারীপুর

মাদবরেরচর, চরজানাজারচর, বন্দরখোলা ও সন্ন্যাসীরচর—মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার এই চারটি ইউনিয়নের নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ২১ জন দরিদ্রের হাতে গতকাল একটি করে ছাগল তুলে দেওয়া হয়। উপজেলার মাদবরেরচর ট্রলার ঘাট এলাকায় এ কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শাহেলা বেগম বলেন, ‘বন্যায় হাঁস-মুরগি বেইচা দিছি। একখান গাই ছিল, হেইডা কম টেকায় হাডে বেইচা দিছি। এহন আম্মেরা মোর মতোন অসহায়রে ছাগল দিলেন। এইডারে পুঁজি কইরা লালন-পালন করে বড় করুম।’

এ সময় উপস্থিত ছিলেন মাদারীপুর বন্ধুসভার সহসভাপতি সোহেল রানা, প্রশিক্ষণ সম্পাদক আরিফুর রহমান, উপসাংগঠনিক সম্পাদক শাহাদাত আকন, দপ্তর সম্পাদক এইচ এম রাসেল, কার্যকারী সদস্য মীর রকিবুল ইসলাম, আসমা আক্তার, আয়শা আক্তার, হৈমন্তী সোমা প্রমুখ।