'চেষ্টা করলে আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি হতে পারি'

এসএসসি পরীক্ষায় অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখা শিক্ষার্থীরা। ১৪ অক্টোবর, সিএ ভবন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা। ছবি: প্রথম আলো
এসএসসি পরীক্ষায় অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখা শিক্ষার্থীরা। ১৪ অক্টোবর, সিএ ভবন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা। ছবি: প্রথম আলো

সামান্য আয়ে সংসার চালান বিনোদ চন্দ্র দাস। মেধাবী ছেলে হৃদয় চন্দ্র দাস পড়াশোনার ফাঁকে বাবাকে সহায়তা করে। এভাবেই জেএসসি ও পিএসসিতে জিপিএ-৫ পায় হৃদয়। পরে সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার বাদশাগঞ্জ পাবলিক হাইস্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ আর ময়মনসিংহ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ থেকেও বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫।

২০১৫ সাল থেকে হৃদয়ের পাশে আছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। এই অদম্যকে বেঁধে রাখতে পারেনি দারিদ্র্য। প্রথম আলো ট্রাস্টের দেওয়া আর্থিক সহায়তা পেয়ে এ বছর তিনি হবিগঞ্জ মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। পড়াশোনা শেষ করে মানুষের সেবা আর অভাবী শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়াতে চান।

আজ ব্র্যাক ব্যাংক ও প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে ৯৬ জন অদম্য মেধাবীকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। অতিথিদের সঙ্গে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারী মেধাবীরা। ১৪ অক্টোবর, সিএ ভবন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা। ছবি: আবদুস সালাম
আজ ব্র্যাক ব্যাংক ও প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে ৯৬ জন অদম্য মেধাবীকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। অতিথিদের সঙ্গে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারী মেধাবীরা। ১৪ অক্টোবর, সিএ ভবন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা। ছবি: আবদুস সালাম

জসিম উদ্দিনের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার নুরাইনপুর গ্রামে। বাবা আজগর জমাদ্দারের দিন আনী দিন খাই অবস্থা। বয়স হওয়ায় এখন আর প্রতিদিন কাজও করতে পারেন না। তাঁর নিজের আয়ে এখন সংসার চলে না। বড় ছেলে জাহিদ তৈরি পোশাক কারখানার কর্মী। জাহিদের দেওয়া টাকায় কোনো রকমে সংসার চলে। মেজ ছেলে মনির হোসেন পটুয়াখালী সরকারি পলিটেকনিক কলেজের তৃতীয় বর্ষে এবং মেয়ে তানিয়া বেগম চট্টগ্রামের একটি কলেজের স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটলেও তাঁরা পড়াশোনা চালিয়ে আসছেন। এর মধ্যে জসিম এবার বরিশাল জিলা স্কুল থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেছে। সৈয়দ হাতেম আলী কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ছে সে। বড় হয়ে হতে চায় চিকিৎসক। সেবা করতে চায় দরিদ্র মানুষের।

হৃদয় বা জসিমের মতো এমন আরও অনেক মেধাবীর গল্পটা একই। নিম্ন আয়ের পরিবারের সদস্য সন্তান এঁরা। পড়াশোনার খরচ দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। তবে প্রথম আলো তাদের পাশে থেকেছে। তারাও ভালো ফল করে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সিএ ভবন মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জানা যায় এসব অদম্য মেধাবী শিক্ষার্থীর কথা। আজ শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় এ অনুষ্ঠান শুরু হয়। এতে প্রথম আলো ও ব্র্যাক ব্যাংকের উদ্যোগে এমন ৯৬ জন অদম্য মেধাবীকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগিতায় ৭৭ জন, ব্যবসায়ী মিতুলী মাহবুবের সহায়তায় ১৫ জন, কানাডাপ্রবাসী মাসুদ উল আলমের সহায়তায় ৩ জন ও ড. ফজলে এলাহীর সহায়তায় ১ জনকে দেওয়া হয় এই সংবর্ধনা।

কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত এই মেধাবীরা। ১৪ অক্টোবর, সিএ ভবন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা। ছবি: প্রথম আলো
কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত এই মেধাবীরা। ১৪ অক্টোবর, সিএ ভবন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা। ছবি: প্রথম আলো

শুরুতে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী অদিতি মহসীন। তিনি ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ ও ‘ও আমার দেশের মাটি’-এই দুটি গান গেয়ে শোনান।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দেন। চীনা নীতির কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, এক বছরের জন্য কোনো কিছুর ফল চাইলে ধান বপন করো, ৩০ বছরের জন্য কোনো কিছুর ফল চাইলে গাছ রোপণ করো আর ১০০ বছরের জন্য ফল চাইলে ভালো মানুষ তৈরি করো। তিনি সবাইকে ভালো মানুষ হওয়ার পরামর্শ দেন। শিক্ষার্থীদের তিনি বলেন, ‘মানুষ যা বিশ্বাস করে, মানুষ তাই হয়। কষ্ট যখন করছ, এক নম্বর হওয়ার জন্যই কষ্ট করো। আমরা চেষ্টা করলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি হতে পারি। আমরা সেই চেষ্টা করি।’

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান সবার প্রতি ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা জানিয়ে বলেন, ‘আমরা সব সময় চেষ্টা করি যেন মানুষের জন্য কিছু করতে পারি। প্রথম আলো সংবাদপত্রের চেয়ে একটু বেশি। আমরা অদম্য মেধাবীদের পাশে দাঁড়িয়েছি, অ্যাসিডদগ্ধদের পাশে দাঁড়িয়েছি। দেশকে মাদকমুক্ত করার চেষ্টা করেছি। এ ছাড়া সিডর, আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বা রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর মানুষের পাশে থেকেছি। নানা সহায়তা করেছি।’ দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ তরুণ। এই তরুণদের শক্তিতে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

সৈয়দ আবুল মকসুদ অদম্য মেধাবীদের সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা আজকে যে অনুপ্রেরণা পেল, তার তুলনা হয় না। তিনি বলেন, যে শিক্ষার্থীরা আর্থিক সহায়তা পেল, তারাও যেন প্রতিষ্ঠিত হয়ে এভাবে আরও শিক্ষার্থীদের সহায়তা করে।

ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের পাশে থাকতে পেরে আমরা গর্বিত।’ সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তোমরা এগিয়ে যাবে। তোমরাই গড়বে আগামী দিনের উজ্জ্বল বাংলাদেশ।’

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্টজনেরা। ১৪ অক্টোবর, সিএ ভবন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা। ছবি: আবদুস সালাম
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্টজনেরা। ১৪ অক্টোবর, সিএ ভবন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা। ছবি: আবদুস সালাম

প্রথম আলো ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান ও বার্জার পেইন্ট বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীদের বলেন, সারা জীবন পরিশ্রম করতে হবে। বাংলাদেশের আরও উন্নতি করতে হবে।

অনুষ্ঠানে সাংসদ ও চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সারা বেগম কবরী, বারডেম হাসপাতালের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুন নাহার, রূপ বিশেষজ্ঞ কানিজ আলমাস খান, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আবদুল কাইয়ুম, এসএ গেমসের স্বর্ণকন্যা মাবিয়া আক্তার বক্তৃতা দেন। সংগীত পরিবেশন করেন জয়, পারভেজ, সাব্বির ও কিশোর। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক।

দর্শক সারিতে বসে আলাপরত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ও গবেষক-কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ। ১৪ অক্টোবর, সিএ ভবন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা। ছবি: আবদুস সালাম
দর্শক সারিতে বসে আলাপরত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ও গবেষক-কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ। ১৪ অক্টোবর, সিএ ভবন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা। ছবি: আবদুস সালাম

প্রথম আলোর কৃতী শিক্ষার্থীদের আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা দেওয়া শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। ওই বছর সিরডাপ মিলনায়তনে এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। সেখানে অনেক শিক্ষার্থী ছিল, যারা দারিদ্র্যের বাধা অতিক্রম করে কৃতিত্ব অর্জন করেছিল। প্রথম আলোর নিজস্ব তহবিল থেকে সেবার বেশ কয়েকজন দরিদ্র শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়।

প্রথম আলো ট্রাস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০৭ সালে অদম্য মেধাবীদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া শুরু করে। ওই বছর ২১ জন অদম্য মেধাবীকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়েছিল। ২০০৯ সাল থেকে এসব অদম্য মেধাবীকে ঢাকায় সংবর্ধনা দেওয়া উদ্যোগ শুরু হয়। এই তহবিলের ইতিমধ্যে মোট ৭৪১ জন শিক্ষার্থী সহায়তা পেয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে বৃত্তি পাচ্ছেন ৩১৬ জন। স্নাতক পর্যায়ে ১৯০ জন।

২০১০ সাল থেকে অদম্য মেধাবীদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়ার আর্থিক দায়িত্ব নিয়ে এতে যুক্ত হয় ব্র্যাক ব্যাংক। তাদের অংশগ্রহণে এ কর্মকাণ্ডের ব্যাপ্তি আরও বেড়ে যায়। এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া অদম্য মেধাবীদের মধ্যে যারা এইচএসসিতেও জিপিএ-৫ পাবে, তাদের উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষাবৃত্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ব্র্যাক ব্যাংক। নির্বাচিত ৫০ জন অদম্য মেধাবী ও পূর্ববর্তী বছরের অদম্য মেধাবীদের যাঁরা পুনরায় এইচএসসি পর্যায়ে জিপিএ-৫ অর্জন করেন, তাঁদের নিয়ে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগিতায় ২০১৫ সালে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া যে ৫০ জন অদম্য মেধাবীকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের মধ্য থেকে এই ১৯ জন এবার এইচএসসিতেও তাঁদের কৃতিত্ব অক্ষুণ্ন রেখেছেন। এই ১৯ জনকে দেওয়া হলো উচ্চতর শিক্ষার জন্য বৃত্তি।