অদম্য এগিয়ে চলা

দুই বন্ধু মামুন মিয়া ও সাহীন হক
দুই বন্ধু মামুন মিয়া ও সাহীন হক

পাশাপাশি চেয়ারেই বসেছিল তারা দুজন। একে অন্যকে যখন দেখল, তখনই মাথায় যেন ভর করল এক অনিশ্চয়তা। শুরু করল মুখ চাওয়াচাওয়ি। দুজনের মনে একই ভাবনা, সকাল থেকে যাকে খুঁজছি ঠিক সে-ই তো? অনিশ্চয়তা নিয়েই একজন জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি মামুন?’ অপরজন, হ্যাঁ-না কিছু না বলে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ল, ‘তুমি সাহীন?’ এরপর কেউ আর কারও উত্তরের প্রত্যাশা করল না, মুখে হাসি ফুটিয়ে করমর্দন করল। শুরু হলো জমানো কথা, তারপর তো দুজনের মুখে কথা সরেই না।

মামুন মিয়া ও সাহীন হকের দেখা হয়েছিল ১৪ অক্টোবর। দুজনই এসেছিল রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সিএ ভবন মিলনায়তনে। তবে তারা একে অন্যের নামের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে এ বছরের ১৪ মে, প্রথম আলোর পাতায়। ‘ভালো ফল করেও দুশ্চিন্তা’ শিরোনামে সেদিন প্রকাশ হয়েছিল দুজনের অভাব জয় করে এসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলের কথা।

সেলফি তুলছেন দুই অদম্য মেধাবী। ছবি: আবদুস সালাম
সেলফি তুলছেন দুই অদম্য মেধাবী। ছবি: আবদুস সালাম

এই হার না-মানা দুই মেধাবী এবার ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী বৃত্তি পেয়েছে। সেদিনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ছিল মামুন ও সাহীনের মতো এইচএসসিপড়ুয়া ৫০ জন সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের কৃতী শিক্ষার্থীকে নিয়ে। যাদের জীবনসংগ্রামের কথা প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম আলোয়। শুধু নতুন শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া ৫০ জন অদম্যই ছিল না, সঙ্গে এইচএসসি উত্তীর্ণ ১৯ জনকে বৃত্তি এবং ডিপ্লোমা ও স্নাতক সম্পন্ন করা ৮ জন অদম্যকেও সংবর্ধনা দেওয়া হয় সেদিন। এমন মেধাবী শিক্ষার্থীরা যত দূর পর্যন্ত উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চায় তত দূর পর্যন্ত বৃত্তি দিয়ে যায় ব্র্যাক ব্যাংক ও প্রথম আলোট্রাস্ট।

সাহীন ও মামুনের সঙ্গে যখন কথা শুরু করি, দুজনই তখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল বাড়ি ফেরার। তবে নতুন বন্ধু হওয়ার আনন্দ তাদের চোখেমুখে লেগে ছিল। মামুন মিয়া বলে, ‘প্রথম আলো থেকে যহন আইতে কইল, তহনই মনে হয়েছিল, সাহীনের সঙ্গে এইবার দেখা হইব। তাই এহানে আইয়াই সাহীনরে খুঁজছি।’ সাহীনও মনে মনে একই কথা ভেবে এসেছিল। অবশেষে তাদের দেখা হলো, হলো বন্ধুত্ব। মুঠোফোন নম্বর আদান-প্রদান করেছে। দুজন দুজনকে বাড়িতে দাওয়াত করেছে। এখন অপেক্ষা, কে কার বাসায় আগে যায়।

ময়মনসিংহের নান্দাইল থেকে মামুন এসেছিল বাবা আবদুল হামিদের সঙ্গে। আর মা পেয়ারা বেগমের সঙ্গে সাহীন এসেছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থেকে। মামুন আগেও ঢাকা এসেছে, তবে সাহীনের এই প্রথম আসা। তাই ভেতরে একটু চাপা উত্তেজনা ছিল সাহীনের। সে বলছিল, ‘আমি তো আগে ঢাকাতেই আসি নাই। লিফটেও চড়ি নাই।’ ছেলের সঙ্গে অনুষ্ঠানে এসে খুশি সাহীনের মা নিজেও। হাসিমাখা মুখে তিনি বললেন, ‘ভালো লিগেছে বাবা।’

মঞ্চে কথা বলছেন মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন
মঞ্চে কথা বলছেন মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন



সাইফুদ্দিনের স্বপ্নপূরণ

সাইফুদ্দিনের প্রিয় শিল্পীদের একজন অদিতি মহসিন। সেদিন অনুষ্ঠানে তার প্রিয় রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী যখন গান ধরলেন, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়...’। অনেকের মতো গলা মেলাল সাইফুদ্দিন। সামনে বসে প্রিয় শিল্পীর গান শুনতে পেরে আনন্দিত সে। সাইফুদ্দিন বলে, ‘আমার কাছে এটা স্বপ্নের মতো মনে হয়েছে।’

সাইফুদ্দিন শুধু যে গান শোনে তা কিন্তু নয়, পল্লিগীতিতে তার দখলও বেশ। স্কুলের মঞ্চে গান গেয়ে দারুণ প্রশংসা কুড়িয়েছিল মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন। বলল, ‘শুধু স্কুলে নয়, আমি কিন্তু টিভিতেও গান গেয়েছি।’

সাইফুদ্দিন চোখের আলো নয়, মনের আলোয় এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। তিন বছর বয়সে এক দুর্ঘটনায় সে দুই চোখের আলো হারায়। কিন্তু দমে যায়নি সাইফুদ্দিন। পড়াশোনার অপার ইচ্ছাশক্তি তাকে সাফল্য এনে দেয়। কিন্তু অভাবের সংসারে তার পড়াশোনা থমকে গিয়েছিল।

এখন পাশে দাঁড়িয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট। এই সহায়তা নিয়ে সে ভর্তি হয়েছে চট্টগ্রামের পটিয়া সরকারি কলেজে।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মঞ্চে ডাকা হয়েছিল সাইফুদ্দিনকে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়েও মুঠোফোনে রেকর্ড শুনে কীভাবে পড়াশোনা চালিয়ে গেছে সে কথাই বলেছেন সবার সামনে। যখন মঞ্চ থেকে নেমে এল, জানতে চাইলাম মঞ্চে উঠে কথা বলতে কেমন লাগল? সাইফুদ্দিন বলল, ‘সামনে যাঁরা বসে আছেন তাঁদের অনেকের নাম আমি জানি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার, আনিসুল হক, কবরীর (সারাহ বেগম কবরী) বক্তব্য আগেও শুনেছি, তাঁরা দেখতে কেমন বলতে পারব না। কিন্তু প্রত্যেকের নিজস্ব চেহারা আমি দিয়েছি। এমন গুণী মানুষদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পেরে খুব ভালো লেগেছে।’

দুই শিক্ষকের সঙ্গে সানিডেইল স্কুলের শিক্ষার্থীরা
দুই শিক্ষকের সঙ্গে সানিডেইল স্কুলের শিক্ষার্থীরা



ছুঁয়ে যায়

তাদের সবার জীবনের কথা অনেকটা একই। দারিদ্র্যের বাধা টপকিয়ে এগিয়ে চলেছে। এই হার না-মানা অদম্য মেধাবীদের কথা শুনতেই ইংরেজি মাধ্যম স্কুল সানিডেইলের আটজন শিক্ষার্থী এসেছিল অনুষ্ঠানে। তারা শুনেছে অদম্য মেধাবীদের কথা। সবার মনে দাগ কেটেছে এই সমবয়সী সংগ্রামীদের কথা শুনে। সে কথার আঁচ পাওয়া গেল দশম শ্রেণির মৃণ্ময়ী গুহের কথায়, ‘সচ্ছল পরিবারে জন্ম হয়েছে বলেই আমি অনেক সুবিধা পাচ্ছি, ভালো স্কুলে পড়ছি। কিন্তু আমার চেয়েও অনেকে মেধাবী, দক্ষ হয়েও ওরা পড়াশোনা করছে কত কষ্ট করে। আমি ভালো আছি—এটা তো আমার নিজের কোনো যোগ্যতা নয়। অদম্য মেধাবীদের কথা শুনে এ কথাটা আমার মনে নাড়া দিয়েছে।’

মৃণ্ময়ীর মতো বাকিদের মনও তখন আর্দ্র হয়ে উঠেছিল। নবম শ্রেণির জাহিন কবির যেমনটি বলল, ‘বাধা ডিঙিয়ে নিজে কিছু করার মধ্যে যে প্রশান্তি তা এখানে না এলে বুঝতাম না। তারা প্রতিকূলতা পেরিয়ে এখানে এসেছে, এটা শুধুই তার অর্জন। আমার মনে হয়েছে, সবার ভালো থাকার জন্য, দেশের জন্য আমাদের অনেক কিছু করার আছে।’