ফেলে যাওয়া শিশুর মায়ায় হাসপাতালে

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের ৩৭ নম্বর শয্যায় নানা ধরনের খেলনা। শয্যার পাশের জানালার তাকে দুধের কৌটা, ওষুধ, কাঁথা, কাপড়চোপড়। শয্যায় খেলায় মগ্ন শিশুটিকে আদর করছেন এক তরুণী। তাঁর নাম রুমা আক্তার (২২)। পরম মমতায় চার মাসের বেশি সময় ধরে শিশুটিকে আগলে রেখেছেন তিনি।
গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর অভিভাবকেরা হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগে ফেলে চলে যান শিশুটিকে। তখন তার বয়স ছিল ১৫ দিন। সে সময় বোনের অসুস্থ মেয়ের দেখাশোনার জন্য একই বিভাগের পাশের শয্যায় ছিলেন রুমা আক্তার। অভিভাবকহীন ওই শিশুর মায়ায় পড়ে যান তিনি। এক মাস আগে নিজের ভাগনি মারা যাওয়ার পরও রুমা বাড়ি ফেরেননি। অজানা-অচেনা শিশুটির জন্য হাসপাতালে থেকে যান তিনি। ঘটা করে শিশুটির নাম ‘আরাফাত’ রাখা হয়। নাম রাখার আয়োজনে রুমার পাশে দাঁড়ান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অজ্ঞাতনামা, অসহায় রোগীদের পাশে দাঁড়ানো যুবক সাইফুল ইসলামও। তিনি বলেন, ‘শিশুটিকে ফেলে যাওয়ার পর পাশের শয্যার রুমা অন্য অনেকের মতো এক-আধটু দেখতেন। এভাবে দেখতে দেখতে তাঁর মধ্যে মায়া বেড়ে যায়। আমি ওয়ার্ডের সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে ওই বাচ্চার নাম রাখি আরাফাত।’
নিউরো সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার চিকিৎসক নারায়ণ ধর বলেন, শিশুটির বেশ কিছু জন্মগত ত্রুটি রয়েছে। সে মেনিনগোমায়োলোসিও রোগে আক্রান্ত। তার দুই পা পক্ষাঘাতগ্রস্ত। শিশুটির মাথা স্বাভাবিকের চেয়ে বড়। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু জটিল সমস্যা রয়েছে। এ কারণে ভর্তির এক দিনের মাথায় অভিভাবকেরা বোঝা মনে করে শিশুটিকে ফেলে চলে যান। ভর্তির সময় তাঁরা যে ঠিকানা দিয়েছিলেন, সে অনুযায়ী খোঁজ নিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। শিশুটির অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। এখন তাকে রুমাই মায়ের আদরে বড় করছেন।
এর আগে ২০১৫ সালের ২৫ জুলাই হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষের পাশে ফেলে যাওয়া হয় আরেকটি নবজাতককে। তাকে নিয়ে ওই বছরের ২৫ আগস্ট প্রথম আলোয় ‘মানুষ মানুষের জন্য’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
আরাফাতের চিকিৎসা এবং অন্যান্য খরচের কিছুটা হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতি, চিকিৎসকসহ অন্য রোগীর স্বজনেরা বহন করছেন। সময়মতো ওষুধ, খাবার দেওয়াসহ শিশুটির যাবতীয় দায়িত্ব পালন করছেন রুমা। তিনি বলেন, ‘এসেছিলাম বোনের মেয়েকে দেখাশোনার জন্য। মাসখানেক আগে বোনঝি নিহা মারা গেছে। আমি এই বাচ্চাকে ছাড়া বাড়ি ফিরব না। তাকে সুস্থ করে বাড়িতে নিয়ে যাব। আমার খালাতো বোন এবং ভাইয়েরা বলেছে ওকে (আরাফাত) নিয়ে যেতে।’ রুমার বাড়ি কক্সবাজারের বাহারছড়া এলাকায়। পড়াশোনায় খুব একটা এগোতে পারেননি তিনি। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে রুমা সবার ছোট।
বিভাগের অন্য রোগীর স্বজনেরা বলেন, শিশুটিকে যখন ফেলে যায়, তখন কালো লিকলিকে ছিল। এই সাড়ে চার মাসে বাচ্চাটি অনেক সুন্দর হয়েছে রুমার যত্নে। এখন রুমার বড় ভয়, যদি বাচ্চাটিকে কেউ নিয়ে যায়!
কিছুদিন আগে এক দম্পতি বাচ্চাটিকে নিতেও আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তাতে বাদ সাধেন রুমা। তিনি বলেন, ‘এ কেমন বাবা-মা, নিজের বাচ্চাকে ফেলে চলে যান। বাচ্চাটির কী দোষ ছিল? এই বাচ্চা আমি কাউকে দেব না। আমিই তার মা, আমিই তার বাবা।’