বাঘ সিংহ হাতি জলহস্তীর আপনজন

নূরুন নবীর কথায় চলে সাফারি পার্কের বাঘ-সিংহ। ছবি: আশরাফুল আলম
নূরুন নবীর কথায় চলে সাফারি পার্কের বাঘ-সিংহ। ছবি: আশরাফুল আলম

ওদের ঠিকানা হতে পারত বনে-বাদাড়ে। কিন্তু এখন ঠাঁই হয়েছে চিড়িয়াখানা কিংবা সাফারি পার্কে। অচেনা-অজানা এসব জায়গায় প্রথম প্রথম হয়তো বিষণ্নতায় ভার থাকত মন। ওদের শুধু খাবার দিতে আসতেন কয়েকজন মানুষ। এই মানুষদের সঙ্গেই হলো সখ্য। তাঁদের একদিন না দেখতে পেলে মন খারাপ হয়; নাওয়া-খাওয়া সব বন্ধ হয়ে যায় ওদের। অচেনা বা অন্য কেউ খাবার এগিয়ে দিলে চুপ করে বসে থাকে। জোরাজুরি করলে ছাড়ে রণহুংকার। চেনা সেই মানুষের দেখা পেলে আহ্লাদে গা এলিয়ে দেয়। জুড়ে দেয় আবদার। এই প্রাণীদের কোনোটিই গৃহপালিত নয়। এরা বাঘ, সিংহ কিংবা হাতি-জলহস্তী। কোনো কোনো মানুষের সঙ্গে বিশাল ও হিংস্র এই প্রাণীগুলোর সম্পর্ক এতটাই গভীর যে একে অন্যের ভাষা বোঝে। বোঝে মনের কষ্ট-দুঃখ। দুইয়ে মিলে গড়ে উঠেছে ভাব আর ভাষার ভালোবাসা।
ঢাকার জাতীয় চিড়িয়াখানা আর গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে গিয়ে দেখা গেল প্রাণীর সঙ্গে মানুষের ভাব-ভালোবাসার নমুনা আর শোনা হলো প্রাণীদের তত্ত্বাবধায়কদের কাহিনি।

.
.

হাতিশালে অন্য ভাষা

লাল মাটি। উঁচু-নিচু ঢালু। অনেকটা পাহাড়ের মতো। চারপাশে সারি সারি শালগাছ। মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য কলাগাছের টুকরো, ফেটে যাওয়া হলদে মিষ্টিকুমড়া ও ভুট্টাগাছ। এটিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের হাতিশাল। ছয় হাতির আবাসস্থল। সারা দিন দর্শনার্থীদের ঘোরানো, খেলা দেখিয়ে হাতিশালেই খাওয়াদাওয়া, ঘুমানো—সব চলে ওদের। হাতিশালে যেতেই হাতিগুলো সাদরে বরণ করে নেয়। মাহুতরা (হাতিদের তত্ত্বাবধানকারী) বললেই শুঁড় উঁচিয়ে অতিথিদের সালাম দেওয়া হাতিদের রীতি হয়ে গেছে। মাহুতদের সঙ্গে হাতিদের একই আলাদা ভাষাও আছে।
আবু তাহের নামের এক মাহুত বলেন, ‘পোষ মানা সব হাতির সঙ্গেই একটি ভাষায় কথা বলি। “বট” বললে ওরা বসে পড়ে। খাবার দিলেই হাতিরা খায় না। “ধ্যাড়” বললে খাবার খেতে শুরু করে। “ছম” বলার মানে হলো হাতিরা ঘুমানোর প্রস্তুতি নেবে, ঘুমিয়ে পড়বে। “হাগো” বলা হলে ওরা সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। আর যদি বলি “পিছো” তখন পেছনের দিকে হাঁটা শুরু করে। এ ধরনের অনেক শব্দ মেলানো একটি ভাষায় আমরা হাতিদের সঙ্গে কথা বলি।’

সাফারি পার্কের হাতিদের আপনজন সাত মাহুত
সাফারি পার্কের হাতিদের আপনজন সাত মাহুত

সাফারি পার্কের হাতিশালে সাতজন মাহুত রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ছয়জনের বাড়ি রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে। একমাত্র আবু তাহেরের বাড়ি সিলেটের পাহাড়ি এলাকায়। সব মাহুতের জন্ম হাতি-অধ্যুষিত এলাকায়। সাফারি পার্কের ছয়টি হাতিও এসেছে বাঘাইছড়ি থেকে।

মাহুত পূর্ণসেন চাকমা বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেক এলাকাতেই হাতি পালার কাজ করেছি। সব হাতির সঙ্গে একই ভাষায় কথা বলতে হয়।’
সাফারি পার্কে ছয় হাতির মধ্যে সবার বড় মুক্তি রানীর বয়স ৪৬ বছর। পূজা রানীর ২০ বছর হয়েছে। অন্যগুলোর মধ্যে আমির বাহাদুরের ১৭, বেলকলির ২৭, কুসুমমালার ৩৪ এবং সেলবাহাদুরের বয়স ৩৫ বছর। এক হাতিকে অন্য হাতির নামে ডাকা হলে সে কথা শোনে না। উল্টো রাগ করে। হাতিদেরই একান্ত আপন মনে করে মাহুত কিরণ বিকাশ চাকমা বলেন, ‘হাতিদের মুখ দেখলে বোঝা যায় মনের অবস্থা। পোষ মেনে গেলে হাতিদের চেয়ে আপন-দরদি কেউ নেই।’

.
.

দুষ্টু সিংহ ‘কানকাটা রমজান’
সাফারি পার্কে ২০টি সিংহ রয়েছে। দাপট দেখিয়ে ওদের সবার যেন রাজা হয়ে গেছে সাড়ে সাত বছর বয়সের একটি সিংহ, নাম ‘কানকাটা রমজান’। যেমন মেজাজ, তেমনি হিংস্র। নতুন নতুন সঙ্গী বদল, অন্য সিংহদের মধ্যে কেউ দলনেতা হওয়ার চেষ্টা করলে কানকাটা রমজানের হামলা চালানোর স্বভাব। রমজানের এই চরিত্র যাঁর নখদর্পণে, তিনি হলেন নূরুন নবী। সাফারি পার্কে ৩২টি সিংহ ও বাঘের তত্ত্বাবধানকারী ২৯ বছর বয়সী যুবক নূরুন নবী।
নূরুন নবী বলেন, ‘কানকাটা রমজান বলে ডাকলে সিংহটি যেখানেই থাকুক না কেন ছুটে আসে। মন ভালো থাকলে কথা বলে। খারাপ থাকলে গর্জন। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসার পর একটি সিংহীকে নিয়ে ওর আরেকটি সিংহের সঙ্গে মারামারি হয়। তখন ওর বাম কান কেটে যায়। এরপর থেকেই সিংহটিকে কানকাটা রমজান ডাকি। এই নামে না ডাকা হলে রমজান কথা শোনে না। ওর সঙ্গে কথা বলতে হয় বাংলা ভাষায়।’

.
.

আরামপ্রিয় বাংলার বাঘ ‘জ্যাকবল’
বেশ কিছু দিন অসুস্থ ছিল বাংলার বাঘ বা বেঙ্গল টাইগার ‘জ্যাকবল’। বেঙ্গল টাইগার প্রজাতির হলেও জ্যাকবলের জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকার খামারে। সেখান থেকে ছোট্ট বয়সে পুরুষ এই বাঘটিকে কিনে আনা হয়। বিদেশি হওয়ায় প্রথম থেকেই বাঘটিকে ইংরেজি ‘জ্যাকবল’ নামে ডাকা হতো। জ্যাকবলসহ মোট ১২টি বেঙ্গল টাইগার আছে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে। এর মধ্যে গত জানুয়ারি মাসে জন্ম নিয়েছে বিজয়, বিলাসী ও মাধবী। ১২টি বেঙ্গল টাইগারের মধ্যে সুন্দরবনের একটি তিন পায়ের বাঘিনী আছে। শিকারিদের ফাঁদে পড়ে বাঘিনীটি পেছনের একটি পা হারিয়েছিল। এক পা হারালেও অবাধ্য সুন্দরবনের বাঘিনী। ওর কোনো নাম নেই, কথাও শোনে না। তবে কথা শোনে আর কিছুটা শান্তশিষ্ট স্বভাবের জ্যাকবল। লম্বা ও মোটাসোটা। শুধু ঘুমাতে চায়।
নূরুন নবী বলেন, ‘জ্যাকবল প্রথমে ইংরেজি বুঝত। আমি ইংরেজি না জানায় বাংলায় কথা বলতাম। এখন জ্যাকবল বাংলা ভাষায় সব বুঝতে পারে। কয়েক দিন আগে বাঘটি অসুস্থ ছিল। তখন আবদার আর আহ্লাদ বেড়ে গিয়েছিল। জ্যাকবল বলে ডাকলেই গর্জন না করে বিড়ালের মতো আওয়াজ করে।’

মিরপুর চিড়িয়াখানার জলহস্তীগুলো বেড়ে উঠেছে নূর আলমের আদর–যত্নে
মিরপুর চিড়িয়াখানার জলহস্তীগুলো বেড়ে উঠেছে নূর আলমের আদর–যত্নে

টিটোর দুঃখে কাতর নূর আলম
মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় সাজানো-গোছানো সংসার ছিল টিটো-ডায়নার। বছর দেড়েক আগে টিটো চলে গেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে। ডায়না ওর ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঢাকা চিড়িয়াখানাতেই আছে। তবে এখানে টিটো-ডায়নার বংশধর ১৪টি জলহস্তী। এদের সবারই দারুণ ভাব রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক নূর আলমের সঙ্গে। ভাব তো থাকবেই। কারণ ৩৫ বছর ধরে টিটো-ডায়নাকে একাই বড় করেছেন নূর আলম। তাই তাঁর সঙ্গে জলহস্তীদের এই ভাব ইঙ্গিত-ইশারায় সীমাবদ্ধ নয়, কথাবার্তা দিয়েও চলে।
নূর আলম বলেন, ‘জলহস্তীরা আমার কথা খুব শোনে। বাংলা ভাষা বেশ ভালো বোঝে। আমি যদি বলি ‘হাঁ’ কর, ওরা মুখ বড় করে। যদি বলি দৌড় দে, তাহলে দৌড় দেয়। ঘরে যেতে বললে ঘরে চলে যায়। তবে কয়েকটি আছে বেশ দুষ্টু। বিশেষ করে কয়েকটি জলহস্তীর মধ্যে বেশ হিংসুটে ভাব রয়েছে।’ জলহস্তীদের চোখ দেখলেই নূর আলম বুঝতে পারেন ওদের মন ভালো আছে কি নেই। আর রাগ করলে চোয়াল বড় হাঁ করে বারবার চাবাতে থাকে জলহস্তীগুলো।
টিটোর জন্য মন কাঁদে নূর আলমের। কোলজুড়ে যখন প্রথম বাচ্চা এল, তখন বেশ মেজাজ ছিল ডায়নার। নূর আলম একবার ওই বাচ্চাকে খাবার দিতে গেলে ডায়না তেড়ে আসে তাঁর দিকে। তখন টিটো এসে ডায়নাকে বাধা দেয়। সেই স্মৃতি মনে করে নূর আলম বলেন, ‘সেদিন যদি টিটো এগিয়ে না আসত, তাহলে আমি মারাই যেতাম। তবে ডায়না এরপর থেকে আমাকে মেনে চলে। টিটোর মতো জলহস্তী আর একটিও নেই। ওরে আমি দেখতে গাজীপুর যাব।’

ঝুঁকির পেশায় নিরাপত্তা নেই
হিংস্র বন্য প্রাণীদের মর্জির ওপর জীবিকা অর্জনে ভরসা নূরুন নবী, আবু তাহের ও পূর্ণসেন চাকমাদের। জীবন বাজি রেখে প্রাণীদের দেখভাল করছেন তাঁরা। কিন্তু দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও চাকরি স্থায়ী হয়নি তাঁদের। নূরুন নবী বলেন, ‘১২ বছর ধরে চাকরি করছি। একটু এদিক-সেদিক হলেই প্রাণ চলে যেতে পারে আমার। ঝুঁকি-ভাতাও নেই। আশ্বাস পাচ্ছি, কিন্তু চাকরি কেন স্থায়ী হয় না, বুঝতে
পারি না।’ তবে এসবের মধ্যেও প্রাণীদের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা কমে না। প্রতিদিন ওদের দেখভাল করে যান আপনজনের মতো।