জীবন ফিরে পেয়েছি, তবে কাজ নেই

‘রানা প্লাজা ধসের সময় আমরা তিনজন হাত ধরাধরি করে ছিলাম। ডান হাত ধরা ছিল পোশাকশ্রমিক সাবিহার হাতে। আমার বাঁ হাতের একাংশের ওপর পিলার চাপা পড়ে। ওই হাতের অন্য অংশ ধরে রাখেন সহকর্মী দিপা। দিপা মারা গেছেন। আমি ও সাবিহা বেঁচে আছি। কিন্তু আমার বাঁ হাতটি নেই। ওই হাত কেটেই আমাকে বের করা হয়েছে। জীবন ফিরে পেয়েছি, তবে কাজ নেই।’

জীবন ফিরে পাওয়ার আনন্দ আর বীভৎস একটি দিনের স্মৃতি নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন সাভারে রানা প্লাজা ধসে এক হাত হারানো লাবণী খানম। সবাই তাঁকে মৌসুমি নামেই ডাকে। এখন তিনি খুলনার দৌলতপুরে টিনশেডের ছোট্ট একটি বাড়িতে ভাড়া থাকেন।

লাবণী বলেন, ‘আমি পড়াশোনা করেছি। এখন একটা চাকরির খুব দরকার। চাকরি না হলে একটি ওষুধের দোকান গড়ার ইচ্ছে আছে। আমার বিশ্বাস, আমি সফল হব।’

আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে ভরা ছিল ২৩ বছর বয়সী লাবণীর। ছিল দুঃখের মাঝেই সুখের সংসার। স্বপ্ন ছিল সংসারটাকে আরেকটু সাজিয়ে তোলার। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায় রানা প্লাজা ধসের মর্মান্তিক ঘটনায়। এক হাত হারিয়েছেন বলে জীবনযুদ্ধে হেরে যেতে চান না তিনি। নিজের মেধা আর ডান হাতের শক্তিতেই জয়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন লাবণী।

গতকাল শনিবার খুলনার দৌলতপুরে টিনশেডের ছোট্ট বাড়িতে বসেই এই স্বপ্নের কথা বলছিলেন লাবণী খানম। এ সময় কখনো তাঁর মুখে ছিল হাসির রেখা, কখনোবা চোখ দিয়ে ঝরছিল কান্নার বিন্দু বিন্দু ফোঁটা। তবে ২০১৩ সালে ২৪ এপ্রিল সেই সকালের কথা মনে পড়লে এখনো আঁতকে ওঠেন তিনি।

লাবণী বলেন, ‘আগের দিন ২৩ এপ্রিল রানা প্লাজায় ফাটল ধরা পড়েছিল। দুপুরে বাড়ি ফিরে আসি। রানা প্লাজার পাঁচতলায় ফ্যানটম গার্মেন্টসের চিকিৎসাকেন্দ্রের নার্স ছিলাম আমি। পোশাক কারখানার কর্মীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া আমার কাজ। ২৪ এপ্রিল কারখানায় যাব কি না, এ নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। তবে মাসের শেষ, অফিসে না গেলে বেতন কাটতে পারে। এ কারণে সকাল সাড়ে আটটার কিছু পরে কারখানায় যাই। এর ১০ মিনিট পরেই রানা প্লাজা ধসে পড়ে। আমার স্বামী আবু মুসা অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিতে সেদিন খুলনায় ছিলেন।’

ঘটনার পরদিন ২৫ এপ্রিল রাত ১১টার দিকে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে লাবণীকে বের করে আনেন ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা। তখন তাঁর বাঁ হাতটি কেটে ফেলা হয়। হাতটি কাটা না হলে মৌসুমিকে হয়তো বের করা সম্ভব হতো না।

ওই দিনের স্মৃতিচারণা করে লাবণী বলেন, ‘আমার কাছে একটি মোবাইল সেট ছিল। মোবাইল সেটটির আলো জ্বালিয়ে উদ্ধারকর্মীদের সিগন্যাল দিই। একজন এগিয়ে এলেও তাঁর মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। আর পিলার ধসে পথ এতই সরু ছিল যে আমাকে বের করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে আমার বাঁ হাতটি কেটে ফেলতে হয়।’

রানা প্লাজা থেকে লাবণীকে উদ্ধার করে নেওয়া হয় সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আড়াই মাস চিকিৎসার পর তিনি গ্রামের বাড়ি নড়াইলের কালিয়ায় ফিরে যান। এরপর শুরু হয় তাঁর নতুন যুদ্ধ। সরকারের ভাতা হিসেবে মাসে ১০ হাজার টাকায় সংসার ও পড়াশোনার খরচ জোগানোর চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু ক্লান্ত শরীরে আর কুলোয় না। তাই দুই বছরের জন্য পড়াশোনা বন্ধ করতে হয় তাঁকে।

এ ব্যাপারে লাবণী বলেন, ‘আমার স্বামী মুসা চাকরি করতেন সাভারে। আমি খুলনা বয়রা মহিলা কলেজে অর্থনীতিতে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়তাম। মুসার জন্যই সাভারে গিয়েছিলাম। বসে থেকে কী করব, তাই সাভার গণশিক্ষায় নার্সিং ডিপ্লোমায় ভর্তি হই। একই সঙ্গে ফ্যানটমে চাকরি শুরু করি। তবে পরিণতি যে এমন হবে, তা কে বলবে!’

এক হাত নেই, তবু এখন সুস্থ আছেন জানিয়ে লাবণী খানম বলেন, ‘এক হাতে কাজ করতে, লিখতে এখন আর অসুবিধা হয় না। তবে রোগীদের তো ইনজেকশন দেওয়া যায় না। এ জন্য দুটি হাত প্রয়োজন। আমি চাকরির আবেদন করেছি। সরকারি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষিকার পরীক্ষা দিয়েছি। কিন্তু এ জন্য টাকা খরচ করতে হবে জেনে আর এগিয়ে যাইনি।’

রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় একটি হাত কেটে ফেলতে হয়েছে লাবণী খানমের। কিন্তু থেমে যায়নি তাঁর জীবনের গতি। ছবিটি শনিবার দৌলতপুরে তাঁর বাসস্থান থেকে তোলা। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় একটি হাত কেটে ফেলতে হয়েছে লাবণী খানমের। কিন্তু থেমে যায়নি তাঁর জীবনের গতি। ছবিটি শনিবার দৌলতপুরে তাঁর বাসস্থান থেকে তোলা। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

চাকরি পাবেন, এমন নিশ্চয়তা না থাকলেও আবার পড়ালেখা শুরু করেছেন লাবণী। অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন এখন। তিনি বলেন, ‘এসএসসিতে আমার নম্বর ছিল জিপিএ-৪.৫০ আর উচ্চমাধ্যমিকে ৪.৭৫। যদি চাকরি না পাই, তাহলে খুলনায় একটি ওষুধের দোকান দেব। আমার স্বামী আমাকে এ কাজে সাহায্য করবেন। তবে পুঁজি নেই। দোকানের অগ্রিম চায় সাত লাখ টাকা। এ ছাড়া মালামাল কেনার খরচ তো আছেই।’

রানা প্লাজায় আহত, তাই অনেকের ধারণা, অনেক টাকা সাহায্য পেয়েছেন লাবণী। মানুষের এই ধারণা লাবণীর জন্য ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছ। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমার চিকিৎসা হয়েছে সরকারি খরচে। তবে আমার মাসিক ভাতা ১০ হাজার টাকা আর স্বামীর বেতন তিন হাজার টাকায় বাড়ি ভাড়া, সংসার খরচ আর পড়াশোনা চলছে। কষ্ট হচ্ছে, হোক; আমি লেখাপড়া শেষ করবই।’