ইশারায় চলে যে রেস্তোরাঁ

রেস্তোরাঁর নাম ‘ওয়ান ট্রি’ বা একটি গাছ। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর কেন্দ্রস্থল দরবার মার্গ। সেখানেই বিশাল রাস্তার পাশে এর অবস্থান। খানিক আগে হওয়া বৃষ্টিতে ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। চারদিকে আলো ঝলমল করছে। সাদা রঙের একটি বোর্ডে ওয়ান ট্রির শৈল্পিক সাইনবোর্ড।

‘ওয়ান ট্রি মানে, গাছের নিচে বসে খেতে হবে নাকি?’ এমন প্রশ্নে গৌতমদা (ভট্টাচার্য) বললেন, ‘অনেকটা এ রকম। চলুন ভেতরে গিয়ে দেখবেন।’
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটির চিফ অপারেটিং অফিসার গৌতম ভট্টাচার্য। এ প্রতিষ্ঠানটি নেপালের সব যানবাহনে ডিজিটাল নম্বর বসানোর কাজ পেয়েছে। সেই কাজ দেখতে বাংলাদেশ থেকে সাংবাদিকদের একটি দলের সদস্য হিসেবে নেপাল গিয়েছি।
ওয়ান ট্রিতে ঢুকেই পেলাম বিশাল এক গাছ। উঠে গেছে ওপরে। রাতে সেই গাছে লাগানো হয়েছে নানা রঙের আলো। গাছটি চারপাশজুড়ে ছড়িয়েছে তার ডালপালা। তারই নিচে তিনটি অংশে সারি সারি চেয়ার-টেবিল। একটিতে গিয়ে বসতেই চলে এলেন কালো-খাকি রঙের পোশাক পরা এক রেস্তোরাঁকর্মী। গৌতম ভট্টাচার্য মুখে শব্দ করে কিছু বললেন না। হাত দিয়ে ইশারায় কিছু একটা বোঝালেন। এরপর আরেক কর্মী এলে তাঁকেও এমনভাবে বোঝালেন। ব্যাপারটা কী? খোলাসা করলেন গৌতম, ‘এ রেস্তোরাঁর খাদ্য পরিবেশনকারীরা সবাই বাক্‌প্রতিবন্ধী। আপনাকে খাবার অর্ডার দিলে ইশারায় বোঝাতে হবে। লিখেও দিতে পারেন।’
ওয়ান ট্রি কাঠমান্ডুর এক বিস্ময়। পরে এ নগরে দুই দিন থেকে স্থানীয় অনেকের কাছেই রেস্তোরাঁটির কথা শুনলাম। শুনে উৎসাহী হই, কেন এই উদ্যোগ। নেপথ্যের কারণই বা কী? পরে আরেক দিন গিয়ে পেলাম রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক জো আরিয়ানকে। পশ্চিমা-শিক্ষিত জো জানালেন, এ গাছটির বয়স ৪০ বছর। আর ৩৫ বছর আগে এ রেস্তোরাঁ চালু করেন শ্যাম কচ্ছপতি নামের এক ব্যক্তি। তিনি খুব সংবেদনশীল ছিলেন বাক্‌প্রতিবন্ধীদের প্রতি। শুরুতে এ রেস্তোরাঁর নাম ছিল নংলা। মাঝে এটি বন্ধ হয়ে যায়। গত বছরের নভেম্বরে জো উদ্যোগ নিয়ে আবার চালু করেন এটি। নাম পাল্টে হয় ‘শ্যামস ওয়ান ট্রি ক্যাফে’।
জো বললেন, ‘যে মানুষগুলো শুনতে বা কথা বলতে পারে না, তাদের নিয়ে কাজ করাটা খুব জটিল। আমি টানা তিন মাস তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এখানে থাকা ২০ জন ওয়েটারই বাক্‌প্রতিবন্ধী।’
জো জানান, তিনজন রেস্তোরাঁকর্মী এখানে আছেন যাঁরা বাক্‌প্রতিবন্ধী নন। আবার রেস্তোরাঁয় যাঁরা রান্না করেন তাঁরাও এ রকম নন।
এ রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন গড়পড়তা ৮০০ জন আসেন। খেতে আসা লোকজনের প্রতিক্রিয়া কেমন? জো বললেন, ‘আমরা একটা জরিপ করেছি। দেখেছি ৮৫ শতাংশ মানুষের তাদের পরিষেবা নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই।’
শুধু খাবার পরিবেশনা নয়, পুরো রেস্তোরাঁ পরিচালনা করতেও দক্ষতা অর্জন করেছেন এসব ভাষাহীন মানুষ। জো বললেন, ‘আমি দুই দিন ছিলাম না। কোথাও কোনো অসুবিধা হয়নি। যারা বলতে, শুনতে পারে তাদের চেয়ে এসব মানুষ কোনো অংশে কম না।’
এ রেস্তোরাঁর প্রতিবন্ধী কর্মী মনিকা রায়। এখানে কাজ করতে কেমন লাগে-রেস্তোরাঁর ক্যাপ্টেন রবি ছেত্রীর মাধ্যমে এমন প্রশ্ন করলে মনিকা বললেন, ‘কোনো অসুবিধা নেই। এখানে আসা মানুষেরাও খারাপ ব্যবহার করেনি।’
মনিকাসহ প্রতিটি কর্মীর বেতন ১৫ হাজার নেপালি রুপি। টিপস, ওভারটাইম মিলিয়ে মাসে অন্তত ২৫ হাজার করে থাকে তাঁদের।
মোহন প্রসাদ হিমিরে তাঁর বান্ধবী মিনা লামাকে নিয়ে খেতে এসেছেন ওয়ান ট্রিতে। মোহন বললেন, ‘এখানে সেবার মান নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কে আমাকে খেতে দিচ্ছে তা কোনো ব্যাপার না। কোনো সমস্যা মনে হয় না।’
রেস্তোরাঁয় পেলাম সিরিয়ার নাগরিক সাফি মোহাম্মদকে। নেপালে বেড়াতে এসেছেন এই ওষুধ প্রযুক্তিবিদ। বললেন, ‘এখানকার ভিন্ন পরিবেশের কথা শুনেই খেতে এসেছি। সবকিছু মিলিয়ে খুব আন্তরিক একটা পরিবেশ।’
নেপালের ঐতিহ্যবাহী থালিসহ চায়নিজ, ভারতীয়, প্রাচ্যদেশীয় সব খাবারই পাবেন এখানে। আছে নানা ধরনের পানীয়।
নেপালের প্রথম সারির কবি, ঔপন্যাসিক বিপ্লব প্রতীক। এ রেস্তোরাঁ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হলো, ‘নাম ওয়ান ট্রি হলেও এই একটি গাছ তার ছড়িয়ে থাকা শাখা-প্রশাখায় নানা কথা বলছে। তুলে ধরছে মানবিকতার কথা। জীবনযুদ্ধে পরাজিত না হওয়ার কথা।’