রোহিঙ্গাদের পাশে বৌদ্ধরা, উড়বে না ফানুস

রাজধানীর মেরুল বাড্ডার আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারের ফটকের পাশেই বসে আছেন কয়েক পুলিশ সদস্য। ফটক পেরিয়ে তাদের জানাতে হলো নাম-পরিচয়। এরপরই যাওয়া গেল ভেতরে। চারপাশে কংক্রিটের ভবনের মাঝখানে খানিকটা খোলা জায়গাজুড়ে এ বৌদ্ধ বিহার। 

বিহারের মূল মন্দিরে বুদ্ধের বিশালকায় অষ্ট ধাতুর মূর্তি। সেই মূর্তিতে প্রণত হচ্ছেন মন্দিরে আসা ভক্তরা। নানা রঙের ফুল, প্রয়াত বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ছবিতে শোভিত এ মন্দিরের ভেতরটা। আর বুদ্ধ মূর্তিটির পাশেই বড় বাক্স। সেখানে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তায় দান দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তিতে প্রণাম জানিয়ে সেই বাক্সে অর্থ দিলেন এক ভক্ত। তাঁর নাম নীলিমা বড়ুয়া। বললেন, ‘অসহায় মানুষকে সহায়তা দিলে তাতো ঈশ্বরের কাজেই লাগে। এখানে কোন ধর্মের মানুষ তা পাচ্ছে তা ভাবার তো দরকার নেই।’
গতকাল বুধবার মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হলো নীলিমাসহ বিহারে আসা কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁদের সবার কণ্ঠেই পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি।
গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর শুরু হয় নির্যাতন। তার পরদিন থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে থাকে। এ পর্যন্ত এ সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। শুরু থেকেই সরকার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-নাগরিক সংগঠন রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ায়। এগিয়ে আসেন দেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষেরাও।
সরকার পরিচালিত বাংলাদেশ বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান সুপ্ত ভূষণ বড়ুয়া বললেন, ‘বিভিন্ন বৌদ্ধ সংগঠন এক হয়ে সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজ নামে একটি জোট করা হয়েছে। এর উদ্যোগে রোহিঙ্গাদের আসা শুরু হওয়ার পর থেকেই তাদের সহযোগিতার চেষ্টা করছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বললেন, উৎসব সংক্ষিপ্ত করে বাংলাদেশের বৌদ্ধরা তাদের ঔদার্যের প্রমাণ দিলেন। রোহিঙ্গারা এ দেশে অসহায় হয়ে এলেন, তখন বৌদ্ধরা তাদের পাশে দাঁড়াল। তাঁদের এ অবস্থান ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।’
গত সেপ্টেম্বরের শুরুতে সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজ গঠনের পর থেকে নানমুখী কর্মসূচি নিচ্ছে সংগঠনটি। গত ১০ সেপ্টেম্বর এক সাংবাদিক সম্মেলনে আজ অনুষ্ঠেয় প্রবারণা পূর্ণিমার অনুষ্ঠানে ফানুস না ওড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। ভিক্ষু শুদ্ধানন্দ মহাথেরো এ ঘোষণা দেন। এরপর ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশানে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানববন্ধনের পাশাপাশি মিয়ানমার দূতাবাসে স্মারকলিপি দেওয়া হয় এ সংগঠনের পক্ষ থেকে। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে ১৪ দলের সঙ্গে বৈঠকে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠক করেন তারা। সারা দেশে বৌদ্ধ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আর্থিক অনুদান তুলে তা প্রধানমন্ত্রী এবং কক্সবাজারে জেলা প্রশাসকের হাতে তুলে দেওয়ার কর্মসূচি দেয় বৌদ্ধ সমাজ। মেরুলের মন্দিরে অনুদান বাক্সে অর্থ নেওয়া সেই প্রক্রিয়ার অংশ বলে জানান বৌদ্ধদের বড় সংগঠন বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক অশোক বড়ুয়া। তিনি বললেন, ‘রোহিঙ্গাদের প্রতি অমানবিক আচরণ আমাদের ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত করেছে। রোহিঙ্গাদের আসার ফলে যে মানবিক সংকটের মুখে আমরা পড়েছি এটা আমাদের জাতীয় সংকট। আমরা এ সংকটে সহায়তা করার জন্য দাঁড়িয়েছি মাত্র।’

রাজধানীর আন্তর্জাতিক বৌদ্ধবিহারে রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। মন্দিরে রাখা আছে দানবাক্স। ৪ অক্টোবর, বাড্ডা, ঢাকা। ছবি: আবদুস সালাম
রাজধানীর আন্তর্জাতিক বৌদ্ধবিহারে রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। মন্দিরে রাখা আছে দানবাক্স। ৪ অক্টোবর, বাড্ডা, ঢাকা। ছবি: আবদুস সালাম

দেশে রোহিঙ্গাদের সহায়তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক নানা ফোরামে এ সংকট নিয়ে সরব হয়েছে দেশের বৌদ্ধরা। এর কিছু উদাহরণ দেন অশোক বড়ুয়া। বৌদ্ধদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড ফেলোশিপ অব বুড্ডিস্টের (ডব্লিউএফবি) আঞ্চলিক শাখা বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশন। এ সংগঠনের কাছে রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের বিষয়টি তুলে ধরেছেন তাঁরা। আর সংগঠনটির মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারকে বার্তা দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এর পাশাপাশি মিয়ানমারে বাংলাদেশের বৌদ্ধদের একটি প্রতিনিধি দলের সফর এবং দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠকের আহ্বান জানানো হয়েছে।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর চীনে বৌদ্ধদের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন শুদ্ধানন্দ মহাথেরো। সেই সম্মেলনে উপস্থিত চীনে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের বিষয়ে উদ্বেগের কথা জানান।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নিপীড়নের প্রতিবাদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে রোহিঙ্গাদের সহায়তা করছেন বৌদ্ধরা।
পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ নামে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটি সংগঠন রাঙামাটির জেলা প্রশাসকের কাছে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় ৫০ হাজার টাকার একটি চেক দেন সম্প্রতি। রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মানজুরুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এ সহায়তা পেয়ে আপ্লুত। এটা মানবিকতার একটি নিদর্শন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে আমি এটিকে দেখছি।’
পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের ভিক্ষু শীলপাল থেরো প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা আমাদের আশ্রিত। তারা প্রচণ্ড ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তাদের সহায়তা করা সবারই দায়িত্ব। এ দায়বোধ থেকেই আমরা সহায়তা করেছি।’ তিনি জানান, অর্থের পাশাপাশি তারা রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সামগ্রী উত্তোলনের কথা ভাবছেন।
পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে বিভিন্ন সংগঠন রোহিঙ্গাদের সহায়তায় অর্থ বা অন্যান্য অনুদান সংগ্রহ করছে। ছাত্রদের এমন একটি জোটের কাছে অর্থ দিয়েছেন খাগড়াছড়ির গোলাবাড়ি মৌজার হেডম্যান উ ক্য চাই চৌধুরী। বৌদ্ধ এবং মারমা সম্প্রদায়ের এই ব্যক্তি বললেন, ‘এভাবে লাখ লাখ মানুষ অসহায় হয়ে আসছে। তাদের প্রতি যে কোনো মানবিক অনুভূতি সম্পন্ন মানুষই সদয় হবে।’