বাঁশের তৈরি 'কাঠের' আসবাব

ফুলের নকশা করা একটি দরজা দেখিয়ে তরুণ গবেষক সাদ্দাম হোসেনের কাছে তাঁর সহকর্মীরা জানতে চাইলেন, এটি কোন কাঠ দিয়ে বানানো। দেরি না করে তিনি উত্তর দিলেন, সেগুনকাঠ। সহকর্মীরা মাথা নেড়ে জানালেন, হয়নি। ঝটপট আরেকটি কাঠের নাম বলার আগেই তাঁকে যা জানানো হলো সেটি তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। দরজাটি বাঁশের তৈরি!

নতুন কর্মস্থলে প্রথম দিনের এই ধাক্কা সামলে বাঁশ দিয়ে কাঠের মতো আসবাব তৈরির গবেষণায় যুক্ত এখন সাদ্দাম। চট্টগ্রামের ষোলোশহরে অবস্থিত বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) গবেষণাগারে সাজিয়ে রাখা দরজা, চেয়ার, খাট, সোফা কিংবা আলমারি দেখে যে কেউ সাদ্দামের মতোই ভুল করেন।

কাঠের দৃঢ়তা, মসৃণতা, গুণাগুণ—সবই আছে এসব আসবাবের মধ্যে। দোকানে বিক্রি হওয়া বাঁশ কিংবা বেতের আসবাব দেখলেই চেনা যায়। কিন্তু বিএফআরআই উদ্ভাবিত আসবাব দেখে বাঁশের অস্তিত্ব সরল চোখে আবিষ্কার করা কঠিন।

দেখতে কাঠের মনে হলেও চেয়ার ও অন্য আসবাবগুলো আসলে বাঁশ দিয়ে তৈরি। চট্টগ্রামের ষোলোশহরে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণাগার থেকে সম্প্রতি তোলা ছবি l সৌরভ দাশ
দেখতে কাঠের মনে হলেও চেয়ার ও অন্য আসবাবগুলো আসলে বাঁশ দিয়ে তৈরি। চট্টগ্রামের ষোলোশহরে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণাগার থেকে সম্প্রতি তোলা ছবি l সৌরভ দাশ

যেভাবে শুরু

দেশি প্রজাতির বাঁশ দিয়ে কাঠের মতো আসবাব তৈরির বিষয়টি নিয়ে ২০০৫ সালে প্রথম ভাবতে শুরু করেন বিএফআরআইয়ের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা ও পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) খুরশীদ আকতার। এ-সংক্রান্ত একটি গবেষণা প্রকল্পও তখন তৈরি করেন তিনি। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল বাঁশ থেকে কম খরচে পরিবেশবান্ধব আসবাব উৎপাদনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা। দেশি বাঁশ থেকে টেকসই আসবাব তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ২০০৯ সালে সফল হন তিনি। তাঁর সঙ্গে শুরু থেকেই আরও দুজন গবেষক ছিলেন। তাঁরা হলেন মাহবুবুর রহমান ও ওয়ালিউল শেখ। নিজেদের প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে টেকসই আসবাব তৈরিতে তাঁরা ব্যবহার করেন চীনের তৈরি যন্ত্র।

গবেষকেরা বলছেন, ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে বাঁশের যোজিত (কমপোজিট) আসবাবের বিকল্প নেই। সেগুনগাছ পরিপক্ব হতে লাগে ৪০ বছর, সেখানে একটি বাঁশঝাড় মাত্র ৪বছরে পরিপক্ব হয়। বাঁশের আবাদ করাও সহজ। ফলে বন ধ্বংস না করে কাঠের আসবাবের চাহিদা বাঁশ দিয়েই মেটানো সম্ভব। গবেষকেরা বলছেন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে তাঁদের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে উদ্যোক্তারাও লাভবান হবেন।

কী আসবাব তৈরি হয়

বিএফআরআইয়ের কাষ্ঠ যোজনা বিভাগের অধীনে চলছে বাঁশের যোজিত পণ্য নিয়ে গবেষণা। এই বিভাগের গবেষণা কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান ও রাকিবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাঁশ দিয়ে ২৫ ধরনের আসবাব তৈরি করেছেন তাঁরা। এর মধ্যে রয়েছে চেয়ার, টেবিল, ডাইনিং টেবিল, বেডসাইড টেবিল, ফ্লোর টাইলস, পার্টিকেল বোর্ড থেকে শুরু করে ঘর ও অফিস সাজাতে ব্যবহৃত নানা ধরনের আসবাব। কাঠের আসবাবের মতোই দেখতে এসব আসবাবের স্থায়িত্ব অন্তত ২০ বছর। দাম সেগুনকাঠের আসবাবের অর্ধেকেরও কম।

কীভাবে আসবাব তৈরি হয়

বাঁশের যোজিত আসবাব তৈরিতে প্রয়োজন পুরু দেয়ালবিশিষ্ট তিন বছর বয়সী বাঁশ। সব বাঁশের দেয়াল পুরু হয় না। দেশি প্রজাতির মধ্যে বাইজ্জা ও বরাক জাতের বাঁশের দেয়াল পুরু বলে আসবাব তৈরিতে এ দুই ধরনের বাঁশই ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বরাক, করজবা, বাইজ্জা, তল্লা, মাকলা, ভুদুম বাঁশ বেশি দেখা যায়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলে জন্মায় বাইজ্জা এবং যশোর ও খুলনা অঞ্চলে বরাক।

বাঁশ থেকে আসবাব তৈরি হয় কয়েক ধাপে। এর জন্য ব্যবহার করা হয় তিনটি যন্ত্র। প্রথমে ব্যাম্বো স্প্লিটার মেশিনে বাঁশগুলো ফালি করে কাটা হয়। ফোরসাইড প্ল্যানার মেশিন নামের একটি যন্ত্রে বাঁশের ফালিগুলো মসৃণ করা হয়। ফালি করা বাঁশের টুকরা এমনভাবে শুকানো হয়, যাতে এর ভেতরের আর্দ্রতা ২০ শতাংশের বেশি না থাকে। শুকানোর পর ফালিগুলো ১০% বোরাক্স-বোরিক অ্যাসিডের দ্রবণে ডুবিয়ে রাখতে হয় দুই দিন। এভাবে ডুবিয়ে রাখাকে বলে কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট (রাসায়নিক সংরক্ষণ)। এই ট্রিটমেন্টের ওপর নির্ভর করে বাঁশের আসবাবের স্থায়িত্ব কত দিন হবে। এ ক্ষেত্রে রাসায়নিক দ্রবণের অনুপাতে গরমিল হলে আসবাব টেকসই হবে না। ট্রিটমেন্ট করা বাঁশের ফালিগুলো নিয়ে যাওয়া হয় হটপ্রেস মেশিনে। সেখানে একটা ফালির সঙ্গে আরেকটা ফালি ইউরিয়া-ফরমালডিহাইড আঠা দিয়ে চাপ দেওয়া হয়। এতে ফালিগুলো জোড়া লেগে তৈরি হয় প্যানেল বোর্ড। প্লাইবোর্ড থেকে যেকোনো আসবাব তৈরি করা সম্ভব।

কোনো কিছুই ফেলনা নয়

স্প্লিটার মেশিন বা ফোরসাইড প্ল্যানার মেশিনে বাঁশ চেরাই করার সময় যেসব গুঁড়া তৈরি হয়, সেগুলো মিক্সচার মেশিনে নিয়ে আঠা যুক্ত করা হয়। আঠা দেওয়া গুঁড়া আবার হটপ্রেস মেশিনে নিয়ে চাপের সাহায্যে পার্টিকেল বোর্ড তৈরি করা হয়। এ ধরনের বোর্ড প্যানেল বোর্ডের মতোই শক্ত।

বাঁশ দিয়ে আসবাব তৈরির গবেষণার উদ্দেশ্য কী জানতে চাইলে বিএফআরআইয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক খুরশীদ আকতার বলেন, সারা বিশ্বেই বনভূমি কমছে। বাংলাদেশে বন ধ্বংসের হার আরও ব্যাপক। সে কারণে বনের গাছ বাঁচাতে বাঁশ দিয়ে আসবাব তৈরির গবেষণা শুরু করেন তাঁরা। একবার বাঁশঝাড় লাগালে সেখান থেকে চার বছর পরপর বাঁশ কাটা যায়। ৩০ থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত একটি ঝাড় থেকে বাঁশ পাওয়া যায়।

এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে উদ্যোক্তারা লাভের মুখ দেখবেন কি না—এই প্রশ্নে খুরশীদ আকতার বলেন, ভবিষ্যতের আসবাব তৈরি হবে বাঁশ দিয়ে। বাঁশ দিয়ে সুন্দর ও পরিবেশবান্ধব আসবাব তৈরি হওয়ায় দেশেও এর চাহিদা তৈরি হবে। তবে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। চীনসহ বিশ্বের অনেক দেশে বাঁশের তৈরি আসবাবের চাহিদা রয়েছে।

এই প্রযুক্তি সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে বিএফআরআই বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এর জন্য নীলফামারী জেলার ডোমারে ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হয়েছে আঞ্চলিক বাঁশ গবেষণা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র। এই কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক রকিবুল হায়দার বলেন, ‘আমরা চাই উদ্যোক্তারা বাঁশের আসবাব তৈরিতে এগিয়ে আসুক। প্রচারণার মাধ্যমে মানুষের অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটানো গেলে বন রক্ষা পাবে। পাশাপাশি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কমবে।’

বাঁশ দিয়ে আসবাব তৈরির ক্ষেত্রে প্রথম ধাপে ব্যাম্বো স্প্লিটার মেশিনে বাঁশগুলো ফালি করে কাটা হয় l প্রথম আলো
বাঁশ দিয়ে আসবাব তৈরির ক্ষেত্রে প্রথম ধাপে ব্যাম্বো স্প্লিটার মেশিনে বাঁশগুলো ফালি করে কাটা হয় l প্রথম আলো

কত টাকা বিনিয়োগ করলে এমন বাঁশের আসবাবের কারখানা তৈরি সম্ভব জানতে চাইলে বাঁশ যোজিত পণ্য প্রকল্পের গবেষণা কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, যে তিনটি যন্ত্র ব্যবহার করে বাঁশের আসবাব তৈরি হয়, সেগুলো আমদানি করতে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকার মতো প্রয়োজন হয়। সব মিলিয়ে এক-দেড় কোটি টাকা বিনিয়োগ করে প্রাথমিকভাবে এমন উদ্যোগ শুরু করা যায়। এ ক্ষেত্রে বিএফআরআই প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের সুবিধা বিনা মূল্যে দেবে।

২০১৪ সালে এ কে খান শিল্প গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এ কে খান প্লাইউড ফ্যাক্টরি বিএফআরআইয়ের প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশে বাঁশের আসবাব নির্মাণ শুরু করে। কারখানায় উৎপাদিত বাঁশের তৈরি ফ্লোর টাইলস এবং অন্যান্য আসবাব বিদেশেও রপ্তানি করে। তবে এখন কারখানাটি বন্ধ রয়েছে।

 এ কে খান গ্রুপের চেয়ারম্যান এ কে শামসুদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অভ্যন্তরীণ কারণে কারখানাটি বন্ধ রেখেছি।’ বাঁশের আসবাব উৎপাদন লাভজনক কি না—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘লাভজনক হয়ে উঠতে সময় লাগবে। তবে বিদেশে এই পণ্যের চাহিদা রয়েছে।’

বাঁশ দিয়ে আসবাব বানানোর প্রযুক্তি দেশে কেন ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে না জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফার্নিচার ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সেলিম এইচ রহমান বলেন, ‘দেশে এখনো এ ধরনের আসবাবের বাজার তৈরি হয়নি। এর জন্য প্রচারণা প্রয়োজন। সরকার রপ্তানিমুখী শিল্পকে যে রকম সুরক্ষা দেয়, বাঁশের আসবাব তৈরির শিল্পকেও সেভাবে সুরক্ষা দিতে হবে। তাহলে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ দেখাবেন।’