'পাহাড়কে পাহাড়ের মতো থাকতে দিন'

‘সমতলের মানুষের মতো পাহাড় কেটে ঘর করার পরিণাম এই পাহাড়ধস। পাহাড়কে পাহাড়ের মতো থাকতে দিতে হবে। নইলে বারবার এমন ধস ঘটবে। প্রাণ ঝরবে মানুষের।’

পাহাড়ধসের ঘটনায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে মানবসৃষ্ট সমস্যাকেও এভাবে দায়ী করলেন জিমিত চাকমা। মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তিনি। বয়স ৫৫ । রাঙামাটির রাঙ্গাপানি এলাকার ওই বিদ্যালয়ে ১৯৮৫ সাল থেকে শিক্ষকতা করছেন। বিদ্যালয় ভবন থেকে প্রধান সড়ক পেরিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে তাঁর বাড়ি। ঘর থেকে বাইরে কোনো কাজে যেতে হলে তাঁকে ১৩২টি সিঁড়ি বেয়ে ওঠা–নামা করতে হয়।
২৯ অক্টোবর বিকেলে মোনঘর স্কুলপ্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলটি আবার ছাত্রছাত্রীর পদচারণে মুখর। সেখানে দেখা হয় জিমিত চাকমার সঙ্গে। বৈঠক ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে অনেক কথা হলো। পাহাড়ধসের দুঃসহ স্মৃতিসহ নানা প্রসঙ্গ উঠে এল।
১৩ জুন রাঙামাটিতে যেদিন ভয়াবহ পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে, জিমিত চাকমা সেদিন তাঁর পাশের ঘরে থাকা দুজন ছাত্রকে ঘুম থেকে তুলে না আনলে তাঁরাও মৃত্যুর মিছিলে মিলে যেত কিংবা থাকত নিখোঁজ মানুষের তালিকায়। পাহাড় বেয়ে জল এসে ভরে যায় জিমিত চাকমার চারচালা টিনের ঘর। গভীর রাতে হঠাৎ করে এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। পানির তোড় ঠেকাতে না পেরে তিন ছুটে যান ছাত্রদের ঘরে। স্যারের ডাকে আচমকা ঘুম থেকে জেগে কিছুই ঠাওরাতে পারছিল না। এরই মধ্যে হুড়মুড়িয়ে পাহাড়ধস। তাঁদের ঘরের ওপর এসে পড়ল মাটির চাঁই। জিমিতের ঘরটা বেঁচে যায় কোনোমতে। তবে ঝুঁকিটা এখনো আছে। ২ মাস ১০ দিন পর অনেকটা বাধ্য হয়েই তিনি ফিরে এসেছেন ঝুঁকিপূর্ণ ঘরে। পাহাড়ধসের পর অন্য ৩৫টি পরিবারের সঙ্গে তিনিও আশ্রয় নিয়েছিলেন মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ে। পাহাড়ধসে রাঙ্গাপানি এলাকায় সেদিন দুজন নিহত হয়।

জিমিত চাকমা বলেন, এই পাহাড়ের উপযোগী গাছ না লাগিয়ে টাকার লোভে ভুল গাছ লাগানো হয়েছিল। এখনো চলছে তা। এটা বন্ধ করতে হবে। এখানকার পাহাড়ে গোদা, চাপালিশ, শিল কড়ই আর চাঁপা ফুলের গাছ ছাড়া অন্য কোনো গাছ লাগানো ঠিক নয়।
জিমিত চাকমা বিরসমুখে প্রথম আলোকে জানান, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করেই ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে শেষ পর্যন্ত ত্রাণশিবির থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে বাধ্য হয়ে তারা আগের জায়গায় ফিরে গেছে। বঞ্চিত প্রান্তিক মানুষদের পাশে এখন কে দাঁড়াবে ? পুনর্বাসনের নামে আমাদের এ এলাকায় যা করার দরকার ছিল, তার কোনোটাই হয়নি।
পাহাড়ধসের বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে রাঙ্গাপানি এলাকার লোকজন। কিন্তু এখনো সে রাতের দুঃসহ স্মৃতি তাঁদের তাড়িয়ে বেড়ায়। এসব মানুষের কথা, পাহাড়ধসের পাশাপাশি আমাদের মানসিক ধসের দিকটাও ভেবে দেখা দরকার।